নির্বাক প্রেম           – উত্তম চক্রবর্তী।

অর্ণবকে ওর কলেজের বন্ধুরা ব্যাকডেটেড বলে খ্যাপাতো। তার কারণ অর্ণবের বাবা ওকে স্মার্ট ফোন কিনে দেবার পর বলে দিয়েছিলেন,’ দ্যাখ বাবা, তুমি এই গ্রাম্য শহর বেলডাঙ্গা থেকে কলকাতায় যাচ্ছ পড়াশুনা করতে। এই মোবাইলের পিছনে সময় কাটিয়ে তোমার পড়াটার ক্ষতি করোনা। অনেক কষ্টে আমাকে টাকা রোজগার করতে হয় তোমাদের ভাই বোনদের পড়াশুনা করিয়ে মানুষ করে সংসার চালাতে। বুঝতেই পারছ একার রোজগারে সংসার চলে। মোবাইলটা যেন শুধু তোমার পড়ার কাজেই লাগে, অন্য কাজে নয়। ঐ আজকাল ছেলে মেয়েরা সারাদিন বসে বসে কি সব ফেস বুক না কী যেন সব দ্যাখে, ওসব দেখতে যেওনা আবার।‘ ব্যস, তারপরেই অর্ণব ঠিক করে আর যাই করুক, ফেস বুক একাউন্ট ও খুলবে না।

সত্যি অর্ণব কলেজ জীবনে ওর ফোনে ফেস বুকে কোন একাউন্ট খোলেনি। তবে ওর বন্ধুরা যখন ফেস বুক খুলে দেখত অর্ণবও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত ওরা ফেস বুকে কী করছে না করছে। মনে মনে ইচ্ছা থাকলেও ওর পড়ার ক্ষতি হতে পারে ভেবেই বাবার পরামর্শকে অমান্য করেনি অর্ণব। এরপর এম এ করার পরেই অর্ণব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেরানীর চাকরি পেয়ে যায়। বৌ বাজারে একটা মেসে থাকে অর্ণব। ওর সাথে আরও চারজন চাকুরে থাকে। মেদিনিপুরের দুটি ছেলে বিকাশ ও সাগর এবং বনগাঁর একটি ছেলে চঞ্চল। বিকাশ অর্ণবকে শুধু খবরের কাগজ আর গল্পের বই নিয়ে বসে থাকতে দেখে ওকে একদিন বলেই ফেলল, ‘আরে অর্ণব, এখন তো তুই পড়া শেষ করে চাকরি করছিস। এখন যদি তুই ফেস বুকে একাউন্ট খুলিস তো আপত্তি কোথায় ? এবার একটা ফেস বুক একাউন্ট খুলে ফেল। দেখবি  কীভাবে টাইম পাস হয়ে যাবে তোর বুঝতেই পারবি না।‘

বিকাশের কথায় উৎসাহিত হয়ে অবশেষে ওর সাহায্য নিয়ে অর্ণব জীবনে এই প্রথম ওর ফোনে ফেসবুক এপ ডাউনলোড করে নিজের নাম ও ছবি দিয়ে একটা একাউন্ট খুলে ফেলল। অর্ণবের চেহারা খুব সুন্দর। গায়ের রং ফর্সা, মাথা ভর্তি চুল, সরু করে কাটা গোঁফ আর লম্বায় প্রায় ছয় ফুট। অর্ণবের ফেস বুকে সাথে সাথে ওর মেসের বন্ধুরাও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ওর ফ্রেন্ড লিস্টে প্রথম নাম লেখায়। সেই থেকেই অর্ণব ছুটির দিনে বা অবসর সময়ে বেশিরভাগ দিনই ওর নতুন ফেসবুক একাউন্টে ঢুকে বসে থাকে। বাবারে বাবা, সে কতরকমের খবর, কতরকমের পোস্ট বা বিজ্ঞাপন না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ফেস বুকের মাধ্যমেই অর্ণব ওর স্কুলের চার পাঁচজন বন্ধুকে খুঁজে তাদের সাথেও বন্ধুত্বর সম্পর্ক রিনিউ করে নিলো।

অর্ণবের কাছেও চেনা অচেনা অনেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। হটাত এক দিন রাতে ডিনারের পর অর্ণব একটা মেয়ের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে একটু অবাক হয়ে গেল। মেয়েটির নাম চিত্রা, থাকে কলকাতায়, বি এস সি পাশ, একটা হাসপাতালে নার্সের চাকরি করছে। চিত্রার ছবি দেখে অর্ণব অবাক হয়ে দেখতে থাকে। কী অপরূপ সুন্দর মেয়েটি। গায়ের রঙ দুধে আলতার মত টকটকে ফর্সা, মুখটা একদম প্রতিমার মত সুন্দর আর চোখদুটো যেন তুলি দিয়ে আঁকা। মেয়েটি ভীষণ সুন্দর ছবি আঁকে। প্রোফাইলে দেখল কয়েকদিন বাদে বাদেই প্রকৃতির সুন্দর সুন্দর ছবি পোস্ট করে।

অর্ণবের কোন গার্ল ফ্রেন্ড নেই। ওর নিচে একটা বোন পূর্ণিমা, এবার বি কম পাশ করল, বিয়ের সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে। তারপর একটা ছোট ভাই বাদল, বি এস সি ফাইনাল ইয়ারে উঠবে। বাবার রেলের চাকরি আর মাত্র দু বছর আছে। অর্ণবের এখন সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবার সময় ঘনিয়ে আসছে। বোনের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে অর্ণব। সুতরাং অন্য পাঁচটা ছেলের মত প্রেম বিলাসী নয় অর্ণব, ভীষণ দায়িত্ববান ছেলে ও।

চিত্রার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট নিয়ে অর্ণব ওর রুম মেটদের মানে বিকাশ, সাগর বা চঞ্চলকে কিছুই জানাল না। কী দরকার বন্ধুদের সব কিছু জানানোর। পরদিন রাতে অনেক ভেবে চিন্তে চিত্রার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নেয় অর্ণব। চিত্রা ওকে ইনবক্সে মেসেজ পাঠায়,’ অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে অর্ণব। আমার মত সামান্য মেয়েকে তুমি তোমার বন্ধু হিসাবে মেনে নিয়েছ বলে আমি ভীষণ খুশী হয়েছি।‘

অর্ণব ওর পুরানো কয়েকজন বন্ধুর সাথে মেসেজে চ্যাটিং করে। কিন্তু একটা মেয়ে এইভাবে ওকে মেসেজ করবে অর্ণব ভাবতেও পারে নি। অর্ণব লিখল,’আরে ধন্যবাদের কী আছে চিত্রা। তুমি এতো ভালো মেয়ে, এতো সুন্দর ছবি আঁক। কেন নিজেকে এতো সামান্য মনে করছ ?’

রাত তখন সাড়ে দশটা বাজে। চিত্রার মেসেজ এলো,’আমাকে তুমি যে সম্মান দিলে অর্ণব জানিনা আমি তার যোগ্য কিনা। তবে আমি তোমার একটা ছবি এঁকেছি আজ। তোমার প্রফাইলের ছবি দেখে দেখে আঁকলাম। তুমি যদি অনুমতি দাও তো তোমাকে সেটা মেসেজ করে শেয়ার করতে পারি। পাঠাবো আমি ?’

অর্ণব খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল যেন। একটা মেয়ে, ওর নতুন ফেসবুক বান্ধবী ওর ছবি এঁকেছে, অর্ণব ভাবতেই পারছিল না। সাথে সাথে লিখল,’ অনুমতির কী আছে চিত্রা। আমরা তো বন্ধু। তুমি এঁকেছ আমার ছবি, সেটা আমি দেখব না ? তাড়াতাড়ি পাঠাও প্লিস। আমি দেখতে চাই সেটা।‘ 

এক মিনিট বাদেই চিত্রার আঁকা অর্ণবের ছবি এসে গেল ওর মোবাইলে। বিস্ময়ে অর্ণবের মুখ হাঁ হয়ে গেল যেন। কী অপূর্ব এঁকেছে মেয়েটা। মনে হচ্ছে অর্ণবের প্রোফাইল পিকচারেরে একটা জেরক্স করে পাঠিয়েছে যেন। পেন্সিল ড্রয়িং যে এতো ভালো হতে পারে অর্ণবের তা ধারনা ছিল না। অর্ণব চিত্রাকে জানাল যে ভীষণ সুন্দর হয়েছে ওর আঁকা ছবি। অর্ণব এই ছবিটাকে ওর প্রোফাইল পিকচার করে রাখবে। চিত্রা যে ওর এই সিদ্ধান্তে বেশ খুশী হল বোঝা গেল যখন ও একটা হাততালির ইমোজি পাঠিয়ে লিখল,’দারুন হবে তাহলে। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ অর্ণব। তুমি শিল্পীর কদর করতে জান।‘

অর্ণবের সাথে চিত্রার এই ভাবেই একটা ডিজিটাল প্রেম গড়ে ওঠে। চিত্রা রোজই রাতে নানা রকম গল্প করে অর্ণবের সাথে চ্যাটিং করে সময় কাটায়। অর্ণব ওর প্রোফাইল ফটো পাল্টে ফেলে চিত্রার আঁকা ফটোটাকে প্রোফাইল ফটো বানিয়ে ফেলেছে। চিত্রা নিজের মন থেকে অর্ণবের বিভিন্ন ভঙ্গির আরও কয়েকটা ছবি একে ওকে পাঠিয়েছে ইতিমধ্যে।

অর্ণব এরপর কিছুদিন ব্যাস্ত রইল ওর বোনের বিয়ে নিয়ে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে পনের দিন কাটিয়ে মাসের শেষে ফিরে এলো কলকাতায় ওর মেসে। এসে দেখল আকাশ আর সাগর মেস ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। শিলিগুড়ি থেকে কমল ও নির্মল নামের দুটি ছেলে এসে ঢুকেছে সেই জায়গায়। চঞ্চল অর্ণবকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। অর্ণব আবার ওর অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মাঝে কয়েকবার চিত্রার সাথে চ্যাটিং হয়েছে। এবার অর্ণব একদিন সন্ধ্যায় চিত্রাকে ফোন লাগায়। অনেকক্ষণ রিং হয়, কিন্তু চিত্রা ফোন তোলে না।

পরদিন রবিবার দুপুরে অর্ণব চিত্রাকে আবার ফোন করল, কিন্তু চিত্রা তবুও ফোন ধরল না। অর্ণব একটু মনক্ষুন্ন হল ঠিকই, কিন্তু ভাবল নিশ্চয়ই চিত্রা ওর হাসপাতালে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অথবা বাড়ির লোকজন এসেছে। অর্ণব শুধু একটা মেসেজ করল ,’পাড়লে একবার ফোন করো। অনেক কথা জমে আছে চিত্রা। আমি একবার তোমার সাথে দেখা করে সব বলব ভাবছিলাম। তা তুমি তো ফোনই তুললে না আমি পরে আরেক বার ট্রাই করব তোমাকে। তখন অন্তত একবার হ্যালো বোলো , নাহলে আমি কিন্তু রাগ করব।‘

বেলা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ অর্ণব আবার চিত্রাকে ফোন লাগাল। ওপার থেকে এবার উত্তর এলো, ’হ্যালো, হ্যালো , কে বলছেন ?’ চিত্রার ফোনে ওর বদলে একজন পুরুষ কণ্ঠ শুনেই অর্ণব ঘাবড়ে গিয়ে লাইনটা কেটে দেয়।  ভাবে এই রে , বোধ হয় চিত্রার বাবা বা দাদা কেউ ফোন তুলেছে এবার। একটু বাদেই ওদিক থেকে ফোন এলো চিত্রার। কিন্তু অর্ণব ভয়ের চোটে সেই ফোন তুললই না। ওর রুমমেট চঞ্চল বাড়ি গেছে ছুটিতে, সোমবার ফিরবে। ফোনের রিং টোন বেজেই যাচ্ছে শুনে ঘরের বাকি দুজন রুম মেট ঘুরে তাকাল অর্ণবের দিকে। কিন্তু অর্ণব ফোনটা কেটেই দিল, তুলল না। ওর ভয় যদি সত্যিই চিত্রার বাবা বা দাদা ফোন তুলে ওকে দুটো কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেয়।

অর্ণব চিত্রাকে এরপর আর কোন মেসেজ পাঠাল না। ভাবল কয়েকদিন চুপচাপ থেকে দেখবে কী হয়। চিত্রা নিজেই ওর সাথে যোগাযোগ করে কিনা। সোমবার থেকে অর্ণব আবার ওর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু লক্ষ্য করল চঞ্চল বাড়ি থেকে ফিরবার পর ওর সাথে কোন কথা বলছে না। যতক্ষন মেসে থাকে  কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকে সারাক্ষন। অর্ণব বা ঘরের অন্য দুজন কিছু বললে শুধু হু হাঁ করে জবাব দেয়। অর্ণব ভাবল চঞ্চল নিশ্চয়ই অফিসের বা পারিবারিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করে সারাদিন।   

শনিবার পর্যন্ত চিত্রার কোন ম্যাসেজ এলো না।। অর্ণব খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে যায়। চিত্রাকে নিয়ে মনে মনে অনেক পরিকল্পনা করে রেখেছে অর্ণব। এবার বোনের বিয়ের পর বাড়ি থেকে ফিরবার আগে মাকে আলাদা করে চিত্রার কথা জানিয়ে মাকে চিত্রার ফটো পর্যন্ত দেখিয়েছে অর্ণব। ওর মা চিত্রার ফটো এবং ওর হাতের আঁকা দেখে খুব খুশী হয়েছেন। অর্ণবকে জানিয়ে দিয়েছেন এই মেয়েকে যদি ও বিয়ে করতে চায় তাহলে ওঁর কোন আপত্তি নেই। অর্ণব জানে মা একবার রাজি হয়েছেন যখন তখন বাবাও আর কোন আপত্তি করবেন না।

রবিবার সকালে চঞ্চল অর্ণবকে চা খেতে খেতে বলল,’চল অর্ণব, আজ আমার সাথে বনগাঁ চল। সন্ধ্যাবেলা ফিরে আসব। আমাদের বাড়িঘর দেখিয়ে আনব তোকে। দেখবি কতো বড় আম বাগান আমাদের। দেখে অবাক হয়ে যাবি। চল,তোকে সব দেখিয়ে আনব আজ।‘ অর্ণব দেশের বাড়ি যাওয়া ছাড়া আজ অবধি কলকাতার বাইরে কোথাও পা রাখে নি। ভাবল ভালই হল, আজ ছুটির দিনটা ভালো কেটে যাবে। স্নান করে ভালো জামাকাপড় পরে রেডি হয়ে বন্ধুর বনগাঁর বাড়ির আম বাগান দেখতে চলে গেল অর্ণব। শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে বেলা সাড়ে এগারোটার একটু আগে এসে পৌঁছল বনগাঁ স্টেশনে। সেখান থেকে অটো রিক্সায় চেপে চঞ্চলদের ছাইঘরিয়ার বাড়িতে এসে নামল ওরা।

ট্রেনে আসতে আসতে চঞ্চল বলেছে ওদের পরিবারের কথা। ওর বাবা ছিলেন ওখানকার গ্রাম পঞ্চায়েতের মাথা। অনেক জমি জায়গা ছিল ওদের। কিন্তু বাবার ভাইদের সাথে জমি জায়গা নিয়ে ঝামেলা কোর্ট কাছারি হবার পর এখন মাত্র পনের বিঘা জমিই ওদের সম্বল। তার মধ্যে দশ বিঘা জমিতে ধান চাষ হয় বছরে দুবার আর পাঁচ বিঘায় আছে একটা বড় আম বাগান। চঞ্চলরা দুই বোন দুই ভাই। বড় দিদির বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগে। এরপর চঞ্চল এবং ওর ভাই শ্যামল বি কম করছে। দুই ভাইয়ের মাঝে এক বোন। ওর বাবা এখন বয়সজনিত রোগে বিছানা নিয়েছেন। চঞ্চলের নাকি বিয়ের সম্বন্ধ দেখা চলছে।

অর্ণব বনগাঁ স্টেশনে নেমে চঞ্চলকে দাঁড় করিয়ে একটা মিষ্টির দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা কিনে নিলো। শত হলেও বন্ধুর বাড়ি এই প্রথম যাচ্ছে অর্ণব। চঞ্চলদের বাড়ি স্টেশন থেকে বারো তেরো কিলোমিটার দুরে। মিনিট কুড়ি  বাদে ওরা যখন সেখানে পৌঁছল তখন বেলা সোয়া বারোটা বাজে। অর্ণব দেখল চঞ্চলদের বাড়িটা বেশ বড় আর অনেক পুরানো, মনে হয় প্রায় একশ বছরের হবে। সামনে পিছনে অনেক গাছ পালা, দোতলা বাড়ি, সামনে লোহার গেট। পিছন দিকে বহু পুরানো রংচটা বাড়িটা দাঁড়িয়ে।

চঞ্চল অর্ণবকে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে প্রথমে ওকে বসবার ঘরে বসিয়ে চলে গেল ভিতরে। একটি একুশ বাইশ বছরের ছেলে এসে চায়ের কাপ ও বিস্কুট সহ একটা ছোট ট্রে রেখে গেল সামনের টেবিলে। অর্ণব বুঝতে পাড়ল এ হল চঞ্চলের ছোট ভাই। জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমিই কি শ্যামল , চঞ্চলের ভাই ?’ শ্যামল মাথা নাড়িয়ে শুধু ছোট্ট করে ‘হ্যাঁ’ বলেই আবার ভিতরে চলে গেল। অর্ণব একটু অবাক হয়ে গেল। বাড়িটা কেমন যেন চুপচাপ লাগছে যেন।

কারণটা একটু বাদেই বোঝা গেল। অর্ণব চা শেষ করার আগেই ঘরে ঢুকলেন একজন বয়স্কা ভদ্র মহিলা, সাধারণ ঘরে পরার তাঁতের শাড়ী, মাথায় সাদা কালো চুল ঘোমটা দিয়ে ঢাকা। দেখেই বোঝা গেল ইনি হলেন চঞ্চলের মা। মহিলার মুখটা বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছিল অর্ণবের। ও হাত জোর করে নমস্কারের ভঙ্গি করে হাসিমুখে চঞ্চলকে জিজ্ঞাসা করল,’ইনি নিশ্চয়ই তোর মা চঞ্চল ? নমস্কার মাসীমা, আমি হলাম অর্ণব। চঞ্চলের রুম মেট। আপনাদের আম বাগান দ্যাখাতে নিয়ে এলো চঞ্চল।‘

মহিলা উল্টো দিকের সোফায় বসলেন। চঞ্চল এসে অর্ণবের পাশে বসল। পিছনের দরজায় উঁকি মারছিল ওর ছোট ভাই শ্যামলের মুখ। চঞ্চলের মা এবার সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন,’তা বাবা, তুমিকি বিয়ে শাদী করেছ নাক আরও দেরিতে বিয়ে করবার পরিকল্পনা আছে তোমার ?’ অর্ণব একটু অবাক হয়ে গিয়ে হেসে জিজ্ঞাসা করল,’কেন বলুন তো মাসীমা ? হঠাৎ বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন ?’ বলেই চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে দেখে ও মাথা নিচু করে মেঝেতে পড়ে থাকা একটা বিস্কুটের টুকরোকে পা দিয়ে সরাচ্ছে।

ওর মা বললেন, ‘না এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম। তা তোমার কি কোন মেয়ে বন্ধু আছে নাকি বাবা ?’

এবার অর্ণব আরও অবাক হয়ে গেল এবং একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ’না মানে, সেরকম কিছু না। তবে একটি মেয়েকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। আমার মাকেও বলেছি সেকথা। তবে মেয়েটির সাথে আমার এই ব্যাপারে যদিও কোন কথা বার্তা হয়নি এখনো।‘

চঞ্চলের মা মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ’এই শ্যামল, দিদিকে মিষ্টির ট্রেটা নিয়ে আসতে বলতো।‘

অর্ণব দেখল চঞ্চল এবং ওর মা দুজনেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। অর্ণব একটু হেসে দরজার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে দাঁড়ালো। একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকছে চিত্রা। ওর চোখ দুটো ফোলা ফোলা। মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকে মিষ্টির ট্রেটা রাখতেই চঞ্চলের মা জিজ্ঞাসা করলেন,’ তুমি কি এই মেয়েটির কথাই বলছিলে বাবা। এ হল আমার ছোট মেয়ে চিত্রা।‘

চঞ্চল অবাক হয়ে বলল,’ চিত্রা, তুমি এখানে ? তুমি তো কলকাতায় থাকো, তাই না ? তাহলে এখানে কীভাবে এলে ? আর চঞ্চল তোমার দাদা মানে … !’

চঞ্চল হেসে বলল, ‘হ্যাঁ রে অর্ণব। সেদিন তোর ফোনটা আমিই ধরেছিলাম। আর চিত্রা কথা বলবে কী করে ? ও তো বোবা, কথাই বলতে পারে না। তোর ফোনের নম্বরটা দেখে চেক করে আর তোর মেসেজ গুলি পড়েই আমি বুঝতে পেরে যাই যে চিত্রা তোর সাথে গোপনে চ্যাটিং করে। তাই তো তোকে নিয়ে এলাম আমাদের বাড়িতে। এবার তুই বল তুই কি এই মেয়েটির কথাই বলছিলি নাকি তোর অন্য কোন গার্ল ফ্রেন্ড আছে ?’

অর্ণব দ্যাখে চিত্রা করুণ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে গোলাপী রঙের ছাপা শাড়ির সামনেটা চোখের জলে ভিজে আছে। বোঝাই যাচ্ছে এই কয়দিন ওর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে আর তাই ও কোন মেসেজ পর্যন্ত করতে পারে নি। হয়ত চঞ্চল ওর মোবাইলটাই নিয়ে নিয়েছে আর ওকে দেখতেই দেয়নি। তার ওপর চিত্রা বোবা শুনেই অর্ণবের বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল। এই এতো সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়েকে ভগবান সব দিলেন , শুধু মুখের ভাষাটাই দিলেন না ! হা ভগবান, এ তোমার কেমন বিচার ?     

চিত্রা, চঞ্চল ওর মা এবং দরজার আড়াল থেকে ওর ভাই শ্যামল সবাই তখন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ণবের মুখের দিকে তাকিয়ে। অর্ণব সামনে দাঁড়ানো চিত্রার দিকে দু পা এগিয়ে গিয়ে ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,’কেন তোমার চোখে জল চিত্রা ? তুমি তো কোন অন্যায় করনি। ফেসবুকে শুধু দুটো মিথ্যা কথা লিখেছ, তুমি কলকাতায় থাকো, একটা হাসপাতালে নার্সের চাকরি করছ। তাছাড়া তো তুমি আমাকে আর কোন ভাবে ঠকাও নি। তাহলে মন খারাপ করছ কেন চিত্রা ? আমি তোমার সাথে দেখা করে একটাই কথা শুধু বলতে চেয়েছিলাম চিত্রা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। বিয়ে করবে আমাকে ?’

চঞ্চল এবং ওর মা চমকে উঠলেন অর্ণবের কথা শুনে। চঞ্চলের মা বলে উঠলেন, ’তুমি কি ভেবে চিন্তে বলছ বাবা ? আমার মেয়েটি জন্ম থেকেই বোবা। সেটা জেনেও তুমি ওকে বিয়ে করবে, কী বলছ কী তুমি ?’ 

অর্ণব সরে গিয়ে চিত্রার তথা চঞ্চলের মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ’আমি চিত্রাকে ভালবেসেছি। ও যেরকমই হোক না কেন, ওকে আমি বিয়ে করে ঘরে তুলতে চাই। আপনি আমাদের আশীর্বাদ করুন মাসীমা। এই চিত্রা, তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন। কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না ? এদিকে এসো, মায়ের পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ চাও।‘

চঞ্চল উঠে এসে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি সত্যিই তোকে ভুল ভেবেছিলামরে অর্ণব। তুই যে এতোটা উদার মনের ভাবতেই পারিনি। আমি ওকে সেদিন ভীষণ বকেছি, গায়ে হাত তুলেছি পর্যন্ত। একটা ভদ্র ঘরের ছেলের মন নিয়ে এভাবে ছেলে খেলা করবার জন্য আমি আর মা দুজনেই ওকে খুব বকেছি রে। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না অর্ণব। আমি সত্যিই লজ্জিত তোর কাছে।‘

‘কিন্তু আমি কিন্তু ভুল বুঝিনি আমার চিত্রা মাকে।‘ কথাটা বলতে বলতে ছোট ছেলের কাঁধে এক হাত রেখে আরেক হাত একটা লাঠিতে ভর দিয়ে ঘরে ঢুকলেন চঞ্চলের বাবা। লম্বা ফর্সা ধুতি আর ফতুয়া পরা ভদ্রলেকের বয়স প্রায় সত্তর বাহাত্তর হবে। অর্ণব ইনি চঞ্চলের বাবা বুঝতে পেরেই এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করল ওঁকে। ভদ্রলোক অর্ণবের মাথায় হাত রেখে বললেন,’ আমার মেয়েটাকে ভগবান শুধু মুখের ভাষাটা দিতে ভুলে গেছিলেন বাবা। কিন্তু ও শুধু একজন খুব ভালো আর্টিস্ট নয়, ভীষণ সুন্দর কবিতা লেখে। ওর লেখা কবিতা অনেক পত্র পত্রিকায় বের হয়। কিরে তুই সেসব জানাস নি অর্ণবকে ?’

কথাটা বলে পাশে এসে দাঁড়ানো চিত্রার দিকে তাকালেন ওর বাবা। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া চিত্রা ঘার নাড়িয়ে জানাল যে ও এসব কিছুই জানায়নি অর্ণব কে। অর্ণব হেসে বলে উঠল, ’আপনার এই অমুল্য সম্পত্তি আমি আপনাদের কাছেই গচ্ছিত রেখে গেলাম। যথা সময়ে আমি সদলবলে এসে ওকে এখান থেকে নিয়ে যাব।‘ বলেই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে অর্ণব বলে ওঠে,’ চল চঞ্চল। আম বাগান দেখাবি না ?’                                          

                      ———শেষ———

* ছবি সৌজন্যে – গুগুল।