একটা অন্তত আয়না সমস্ত গৃহস্থের বাড়িতেই থাকে, সেটা ছোটই হোক বা বড় আয়নাই হোক। ঘরের ভিতর হোক বা বাথরুমে হোক। দোতলা বাড়িটার ছাঁতের পূর্ব দিকের তিন তলার একমাত্র বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা এক চিলতে ঘরের ভিতরেও যে একটা আয়না দেখতে পাবে সেটা ছোট্ট নোটন ভাবতেও পারেনি। আজ থেকে ওদের স্কুল ছুটি। খুলবে সেই এপ্রিলের শেষে, যখন নোটন ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠবে। আর স্কুল খুলেই নতুন ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। নোটন ঠিকই করে রেখেছিল আজই ও ছাঁতের ঐ ঘরটা খুলে সেটাকে ওর খেলবার ঘর বানাবে। মাকে অনেক বুঝিয়ে তার আঁচল থেকে তালার চাবিটা খুলে নিয়েই চলে এসেছে ছাঁতে।

নোটন শুনেছিল ঐ ঘরে নাকি ওর ঠাকুরদার আমলের ভাঙ্গা চেয়ার টেবিল আলনা বইয়ের তাক ইত্যাদি রাখা আছে। কেউ ঐ ঘরে যায়না কারণ তাদের ঐ ঘরের দরকার পড়ে না। ছোট্ট নোটন বাবার অনুমতি নিয়েছে আগেই। এবার মাকেও আজ জানিয়েছে, আর আবদার করে অভিমান কান্না কাটি করে মাকে পটিয়েছে। নোটনের মা চাইছিলেন না ঐ ধুলো বালি আর জঞ্জালের মাঝখানে গিয়ে পড়ুক তার ছেলেটা। যা দুষ্টু, সব ভেঙ্গে চুরে শেষ করে ফেলবে। শেষ পর্যন্ত বাড়ির চাকর বিশুদাকে সাথে করে চাবি দিয়ে পাঠালেন ছেলেকে শান্ত করতে তিনতলার ছাঁতের ঘরে।

বিশুদা এই বাড়িতে আছে প্রায় চোদ্দ বছর। কিন্তু ঐ ছাঁতের ঘরে কোনদিন ঢোকে নি। ঘরটাতে পিছন দিকে একটা বন্ধ জানালা আছে সেটা নিচের বাগান থেকেই দেখেছিল বিশুদা। বিশুদার বয়স এখন চল্লিশের ওপর। বিয়ে সাদি করেন নি। উড়িষ্যার রাউরকেল্লা থেকে এই সর্বহারা মানুষটাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন নোটনের বাবা অনিন্দ্য চৌধুরী পনের বছর আগে। প্রথমে বিশুদাকে ওদের ফ্যাক্টরিতে কাজ দেওয়া হয়, পরে অনিন্দ্য বাবু তাকে বাড়িতে চাকর হিসাবে নিযুক্ত করে দেন। সেই থেকেই বিশুদা এই বাড়িতে থাকে।

বিশুদা খুব সাহসী মানুষ, ছাঁতে এসেই খুলে ফেলল তালাটা। অনেক দিন বাদে খোলা হল বলেই হয়ত একটা ক্যাঁচ করে শব্দ শোনা গেল আর কাঠের দরজাটা খুলতেই হঠাৎ ঝটপট করে কয়েকটা চামচিকা বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে। বিশুদা আর নোটন দুজনেই চমকে উঠেছিল ওদের দেখে। এই চামচিকা গুলি ঢুকল কোথা দিয়ে ? এরপর যদিও এদিক ওদিকে তাকিয়ে ওদের আর দেখতে পাওয়া গেলো না।

ঘরটার সাইজ খুব বেশি হলে নয় ফুট বাই আট ফুট হবে। খুবই ছোট ঘর। সামনেই একটা বড় বহু পুরানো কাঠের আলনা উল্টে পড়ে আছে। তার পিছনে কাঠের তৈরি ভাঙ্গা চেয়ার, টেবিল, জল চৌকি, বইয়ের তাক, পুরানো টি ভি সেট এসব জিনিষে ঠাসা ঘরটা। একদম পিছনের জানালার ঠিক পাশেই দেখা গেল সেই একমাত্র ঝকঝকে পরিষ্কার কাঁচের বড় দেওয়ালে ঝোলানো আয়নাটা। ঘরের চারদিকে এতো নোংরা ধুলো, মাকড়সার জাল, ধুলোর মধ্যেও সেই আয়নাটা এতো ঝকঝকে পরিষ্কার আছে কী ভাবে সেটা দেখেই আশ্চর্য হয়ে গেলো বিশুদা। দুটো চেয়ার সরিয়ে গিয়ে আয়নাটাতে হাত দিতেই কেমন যেন একটা বিদ্যুত খেলে গেল ওর সমস্ত শরীর দিয়ে।

বিশুদা এক ঝটকায় নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আয়নাটার দিকে। কেন যেন ওর মনে হল আয়নার ভিতর থেকে ঠিক নোটনের ঠাকুরদা নির্মল চৌধুরীর মত একটা আবছা ছায়া বিশুদার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। বিশুদার নিজের চোখকে বিশ্বাস হলনা। দুই হাতে চোখ রগড়ে নিয়ে আবার তাকিয়ে দেখে সেখানে কিছুই নেই।

সারা সকাল নোটন আর বিশুদা মিলে ঘরের মধ্যে জমিয়ে রাখা ঐ সমস্ত ভাঙ্গা আসবাব পত্র ছাঁতের মাঝখানে এনে রাখল। রয়ে গেল শুধু সেই দেওয়াল আয়নাটা। নোটন দুপুরে খাওয়ার সময় ওর মাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেড়েছিল যে ঐ বেলজিয়াম কাঁচের আয়নাটা নোটনের ঠাকুরদা ব্রিটিশ জমানায় জেলখানায় বসে অর্ডার করে পেয়েছিলেন। উনি ছিলেন একজন দেশভক্ত বিপ্লবি এবং রাজবন্দী। অনেক আগে ব্রিটিশ জমানায় রাজবন্দীদের অনেক সুবিধা দেওয়া হত। সেই সময় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের বিশিষ্ট রাজনৈতিক কয়েদি নির্মল চৌধুরী ঐ আয়নাটা আনিয়ে ছিলেন।

দুপুরে খাওয়ার পর বিশুদাকে নিয়ে আবার ছাঁতের সেই ঘরে চলে গেল নোটন। বিশুদা এবার ঝাঁটা আর বালতিতে করে জল ও ন্যাকড়া নিয়ে এসেছে। বৌদি মণি বলে দিয়েছেন ঐ আয়নাটা ঐ ঘরেই থাকবে। ওটা বের করবার কোন দরকার নেই। ওটা শ্বশুর মশাইয়ের জেলখানার স্মৃতি। ওটা ঐ ঘরেই থাক। নোটনের একটাই উদ্দেশ্য। একটা পায়া ভাঙ্গা টেবিলকে ঠিক ঠাক করিয়ে সেটার উপর ক্যারাম বোর্ড রেখে ওর বন্ধুদের নিয়ে ক্যারাম খেলা, বাবার সাথে ক্যারামের ম্যাচ খেলা আর শেষে ওর বন্ধুদের মধ্যে একটা ক্যারাম কম্পিটিশন করা। নোটন ঠিক করে রেখেছে, ওর দাদুর নামে দুইটা ট্রফি কিনে সেগুলি উইনার আর রানার্সকে দিয়ে দেবে।

ঐ দিন সন্ধ্যার আগেই পেরেক আর হাতুড়ির সাহায্যে বিশুদা বড় টেবিলটাকে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর নোটন আর বিশুদা সেটাকে ধরে ধরে ঘরের মাঝখানে এনে রাখল। তার আগেই বিশুদা ঘরটা ঝেড়ে পুছে একদম ঝকঝক করে রেখেছিল। নোটন কোথা থেকে একটা একশ পাওয়ারের বাল্ব জোগাড় করে এনে বিশুদাকে দিয়ে সেটা লাগিয়ে বাইরের দিক থেকে দরজা আটকে দিয়ে বিশুদার সাথে নিচে চলে আসে। কিন্তু মনটা পড়ে থাকে তিন তলার ঘরে।

সেই দিনই গভীর রাতে বিশুদা নিচের দোতলার রান্না ঘরের পাশে ওর শোবার ঘর থেকে শুনতে পায় ওপরে তিন তলার ঘরে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। কান খাড়া করে শুনতে পায় কয়কজন মানুষের কণ্ঠস্বর। বিশুদা উঠে পড়ল আর একটা টর্চ নিয়ে পা টিপে টিপে তিনতলায় যাবার সিঁড়ির সামনে এসে পরিষ্কার শুনতে পেল ওপরের ঘরে কারা যেন ফিস ফিস করে কথা বলছে। বিশুদার কানে শুধু এলো ‘আমিও খেলব, আমিও খেলব’ এরকম দুজনের গলার আওয়াজ। কী খেলব, কেন খেলব, কারা এরা, এইসব ভাবতে ভাবতেই বিশুদা আবার নিঃশব্দে নিজের শোবার জায়গায় এসে ধীরে ধীরে গভীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।

পরদিন সকালে বৌদি মনির জন্য পিছনের বাগানের ফুল তুলতে গিয়ে বিশুদার চোখ চলে গেল ওপরে তিনতলার ঘরটার দিকে। আশ্চর্য ব্যাপার। ওপরের ঐ ঘরের জানালাটা খুলল কে ? বিশুদার পরিষ্কার মনে আছে কাল ওদের দুজনের কেউই ঐ জানালায় হাতও দেয়নি। ওরা ঘর পরিষ্কার করতে ব্যস্ত ছিল। বিশুদার কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল। তাহলে নিশ্চয়ই রাতে চোর এসছিল বাড়িতে।

বিশুদা তাড়াতাড়ি ফুল তুলে এনে নোটনের ঘরের সামনে এসে ওর ভেজানো দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখল নোটন ঘরে নেই। বিশুদা ভাবল ছোট বাবু নিশ্চয়ই বাথরুমে গেছে। বেরিয়ে এসে রান্না ঘরে গিয়ে বৌদি মণির হাত থেকে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে চলে গেল দাদাবাবুর ঘরে। কিন্তু বড় বাবুকে চা দিয়ে ফিরে এসেও বিশুদা দেখে নোটন ঘরে নেই। তাহলে কি নোটন ছাঁতে গেছে ? বিশুদা তিনতলার সেই ঘরে এসে দেখে নোটন টেবিলের একপাশে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছে। বিশুদা তাকিয়ে দেখল উল্টো দিকের জানালাটা বন্ধ। বিশুদা জিজ্ঞাসা করল, – তুমি কি ঐ জানালাটা খুলেছিলে নোটন ? আমি নিচ থেকে দেখলাম ওটা খোলা ছিল একটু আগে।‘

নোটন অবাক হয়ে গেল শুনে। বিস্মিত চোখে একবার জানালাটাকে দেখে নিয়ে বলল, – কই নাতো। আমি তো এসে দেখলাম ভিতর থেকে বন্ধ আছে। ঐ তো ওর ছিটকানিটা তো এখনো আটকানো। তুমি ঠিক দেখেছ তো বিশুদা ? এটা খোলা ছিল!’  বিশুদাকে এই বাড়ির সবাই বিশুদাই ডাকে। নোটনও ছোট থেকেই ওকে বিশুদা বলেই ডাকে। নোটনের জবাব শুনে বিশু অবাক হয়ে গেল। তাহলে তখন ঐ জানালা কে খুলেছিল ? ঘরের ভিতর থেকে রাতে কারা ফিসফিস করে কথা বলছিল কাল রাতে ? বিশুদা এবার এগিয়ে গিয়ে নিজেই জানালাটা খুলতে চেষ্টা করল, কিন্তু ছিটকানিটা কিছুতেই ঘোরাতে পারল না। এতো পুরানো হয়ে গেছে যে জং ধরে গিয়ে আটকে আছে। জানালাটা খোলাই গেলো না। বিশুদা ভাবল পরে এসে নারকেল তেল দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে তারপর ছিটকানিটা আবার চেষ্টা করলেই হয়ত খুলে যাবে।

বিশুদা এবার আবার আয়নাটার দিকে তাকাল। কিছুই দেখতে পেলো না। আস্তে করে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিল আয়নার মাঝখানটা। আবার ওর শরীর দিয়ে বিদ্যুত খেলে গেল যেন। নোটন তখন ছাঁতে গিয়ে ওদের পুরানো ভাঙ্গা চেয়ারগুলি পর্যবেক্ষণ করছে, যদি একটা চেয়ার অন্তত ঠিক করে নেওয়া যায়। তাহলে এই ঘরে বসেই ও গল্পের বই পড়তে পারবে। এদিকে বিশুদা আজ অবাক হয়ে গেল আয়নায় নোটনের ঠাকুরদা আজ একা নন। ওঁর পাশে দাঁড়ানো নোটনের ঠাকুমা বিশুদার দিকেই তাকিয়ে হাসছেন। বিশুদার মনে পড়ে গেল ঐ মহিলার হাতের তৈরি নারকেলের নাড়ুর কথা। বিশুদার হাত তখনো আয়নায় রাখা। বিশুদা একটু ভয় পেয়ে হাতটা সরিয়ে নিলো। আর ঠিক তখনই সেই ছায়া দুটো উধাও হয়ে গেল।

বিশুদা বেশ বুঝতে পারল যে এই আয়নাটার মধ্যে প্রেতাত্মা আছে। ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো ওপরে একদিকে একটা ঘুলঘুলি আছে। সেখান দিয়ে সূর্যের আলো আসছে। তারমানে ঐ ফাঁক দিয়েই চামচিকা গুলি ঢোকে। বিশুদা ভাবল কাল অনেকগুলি চামচিকা ছিল এই ঘরে। আত্মারা নাকি দিনের বেলা বাদুড় বা  চামচিকা রূপ ধরে থাকে। ওদের ঘরে ঢুকতে দেখেই ঐ চামচিকা গুলি চলে গেছিল কাল। পরে হয়ত আবার এসে ঐ ওপরের ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকেছিল। ওরাই হয়ত কাল রাতে কী সব খেলার কথা আলোচনা করছিল। বিশুদা আয়নাটার দিকে তাকিয়ে দেখল আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

বিশুদা আবার আয়নায় হাত রাখে। আবারো ওর শরীরে একই রকমের ঝাকুনি লাগে। বিশুদা এবার অবাক হয়ে দেখে ওর নিজের মৃত মা বাবা আর পিসিমার আত্মা আয়নার ভিতর থেকে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু নোটনের দাদু দিদার কোন দেখা নেই। বিশুদা অনেকক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কেউই কোন কথা বলছিল না। বিশুদার চোখে জল চলে এসছিল। হাতটা সরিয়ে নিল চোখ মুছবার জন্য। তখনই সবাই আবার ভ্যানিস হয়ে গেল কোথায়।

বিশুদা এই আয়নার মধ্যে ছায়া দেখবার কথা সেদিন আর কাউকেই জানাল না। ভাবল একদিন রাতে নিজে এসে এটা খুলে দেখতে হবে। রাত্রিবেলা এই ঘরে কারা আসে আর কেনই বা আসে। মানলাম না হয় এই বাড়ির বড় কর্তা আর বড় গিন্নিমার আত্মা এখানে এই আয়নায় বাস করেন। কিন্তু ওর বাবা মা পিসি এরা এখানে এসছেন কী করতে ? বিশুদাকে এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে। বিশুদা ঠিক করল আজ রাতেই এই ঘরে হানা দিতে হবে। বাইরে এসে নোটনকে খুঁজতে গিয়ে দেখল সে একটা চেয়ারকে ঠিক করা যাবে কিনা সেটা ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। বিশুদাকে সেটা জানাতেই বিশুদা ওকে বলল, – এখন নিচে চল ছোট বাবু। আমি পরে এসে এটা ঠিক ঠাক করে দেব। তুমি বরং বাবাকে গিয়ে ক্যারাম কেনার কথা বল। পারলে আজই বাবাকে নিয়ে গিয়ে একটা ক্যারাম বোর্ড কিনে আনো গিয়ে। তাহলে কাল থেকেই তুমি বন্ধুদের নিয়ে এই ঘরে ক্যারাম খেলতে পারবে।’

নোটন সেদিন শুধু বাবাকে নিয়ে ক্যারাম বোর্ড কিনল না, ওর পাড়ার চার পাঁচজন বন্ধুকেও বিকেলে আমন্ত্রন জানিয়ে এলো। সাড়া বিকেল ওরা কয়েকজন মিলে খুব হৈ হৈ করে ক্যারাম খেলে শেষে যে যার ঘরে ফিরল। এর মধ্যে সেই আয়নার দিকে কেউই আর তেমন নজর দেয়নি। কিন্তু বেশি রাতের দিকে বিশুদার কানে এলো ছাঁতের ঘরে কারা যেন ক্যারাম খেলছে। শুধু পুরুষরা নয়, মহিলার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল যেন। বিশুদা বুঝতে পাড়লেন যে এনারা সেই প্রেতাত্মা যারা চামচিকা হয়ে ঐ ঘরে এসে রাতের বেলায় থাকেন। বিশুদা একটা টর্চ নিয়ে পা টিপে টিপে চলে গেল ছাঁতের সিঁড়ির দিকে। যতই কাছে যায় ততোই শব্দটা আরও স্পষ্ট হয়ে কানে আসে।

বিশুদা ছাঁতের ঘরের দরজায় গিয়ে ওপরের শিকলটা খুলতেই ভিতরে ভূতদের ক্যারাম খেলা বন্ধ হয়ে গেল। বিশুদা তবুও ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে দেখল চারিদিক। দেখল ক্যারামের গুটি গুলো বোর্ডের মধ্যে ছড়ানো। কিন্তু কোথাও আর কিছু নেই। বিশুদা একবার আয়নাটার দিকে তাকিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আজ আয়নাটা কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। বিশুদা আয়নাটায় হাত দিতেই আবার ওর শরীরটা ঝাঁকিয়ে উঠল। এবার বিশুদা দেখল আয়নার ভিতর সস্ত্রীক নির্মল চৌধুরী এবং ওর স্বর্গত বাবা মা ও পিসিমা দাঁড়িয়ে গম্ভীর হয়ে বিশুদাকে দেখছেন।

বিশুদা বুঝতে পারল ওদের খেলায় ডিস্টার্ব হয়েছে দেখেই হয়ত তেনারা ওর উপর রেগে আছেন। ধীর পায়ে পিছন ফিরে বিশুদা ঘরের লাইট নিভিয়ে দরজা আটকে নিচে চলে যায়। ভাবে কালই সকালে ব্যাপারটা নিয়ে কর্তা বাবুর সাথে আলোচনা করতে হবে। সকালে উঠে বিশুদা আগেই নোটনকে জিজ্ঞাসা করল ঐ আয়নাটায় ও কখনো হাত রেখেছে কিনা। নোটন রাখেনি বলেই হঠাৎ কী মনে করে ছাঁতে চলে গেল। বিশুদাও গেল পিছন পিছন কী হয় দেখতে। নোটন স্বাচ্ছন্দে আয়নার মধ্যে ওর হাত রাখল বারবার তাকাল সেদিকে, কিন্তু ওর মধ্যে বিশুদা কোন রিএকশন লক্ষ্য করল না।

নোটনের বাবা অনিন্দ্য চৌধুরী বিশুদার কাছ থেকে ওর এই তিন দিনের অভিজ্ঞতা জানতে পেরে প্রথমে মুচকি হাসলেন, কিন্তু তারপর সন্দেহ দুর করবার জন্য বিশুদাকে নিয়ে গেলেন ছাঁতের ঘরে। আগেই গিয়ে পিছনের জানালাটা খুলে সামনের দরজা আটকে দিয়ে আয়নায় হাত রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল ওর সমস্ত শরীর। একটা বিদ্যুত খেলে গেল যেন।  অবাক হয়ে অনিন্দ্য বাবু দেখলেন আয়নায় ওর মৃত বাবা মা’র ছায়া ভেসে উঠেছে। বিশুদাও তেনাদের পিছনে ওর বাবা মা আর পিসিমাকে দেখতে পেল। দুজনেই হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল আয়নাটার দিকে।

একটু বাদেই বিশুদাকে অবাক করে দিয়ে অনিন্দ্য বাবু নিজের হাতে আয়নাটা হুক থেকে খুলে নামিয়ে মেঝেতে আছড়ে ফেলে ভেঙ্গে ফেললেন। বুঝতে পাড়ছিলেন যে এই আয়নায় প্রেতাত্মার বাস এবং সেটা পরে কোনদিন ভয়ানক হয়ে উঠলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ছেলেটার আবার কোন ক্ষতি না হয়ে যায়। আয়নাটা টুকরো টুকরো হয়ে চারিদিকে ভাঙ্গা কাঁচ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।

পরে তার স্ত্রীকে আয়নাটা পরিষ্কার করার সময় হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে গেছে বললেও রাতের দিকে অনিন্দ্য বাবু স্বপ্ন দেখলেন ওর বাবা মা হাসি মুখে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। সেই একই রকম স্বপ্ন দেখল বিশুদাও। কর্তা বাবুকে জানাতে গিয়ে শুনল উনিও সেই একই স্বপ্ন দেখেছেন। দুজনেই ভাবল তার মানে এতদিন যাবত বন্ধ থাকবার পরে বোধ হয় সত্যিই এবার ওঁদের আত্নার মুক্তি হল। হয়ত শুধু তাদের পুত্র দের দেখা দিতে ওঁরা এসে থাকতেন এই আয়নায়। নাহলে নোটন এতদিনে কিছুই দেখতে পেলো না কেন।

             ——-শেষ——