দেব দূত       – উত্তম চক্রবর্তী।

আগের কোম্পানির দেওয়া সিম কার্ড চলে যাওয়ায় কলকাতা থেকে দিল্লিতে এসে দেব এবার ঠিক করেছে নিজেই একটা নতুন সিম কার্ড কিনে নিয়ে ওর স্মার্ট ফোনটাতে লাগিয়ে নেবে। নতুন কোম্পানি দেবকে একটা ফারনিশ ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছে কোম্পানির খরচায়। কোম্পানির এইচ আর ম্যানেজার একটা এড্রেস প্রুফ সারটিফিকেট লিখে দিল পর দেব কাছাকাছি একটা এয়ারটেলের স্টোরে গিয়ে পছন্দ মত একটা নম্বরের সিম কার্ড কিনে ওর নতুন ঠিকানায় ফিরে এলো। সিম কার্ড একটিভেট হয়ে যাবার পর পরদিন সকালেই কলকাতার বাড়িতে ফোন করে বাবাকে আর বন্ধুদের মেসেজে দেব নিজের নতুন নম্বরটা পাঠিয়ে দিল।   

এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল দেব। পনের দিনের মাথায় রাত সাড়ে আটটা নাগাদ টি ভিতে যখন বাংলা খবর দেখছিল দেব ঠিক তখনই এলো একটা অচেনা নম্বর থেকে সেই ফোনটা। দেব টি ভির আওয়াজ কমিয়ে দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে ‘হ্যালো…হ্যালো’ করতে থাকে। বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলবার পরেও অপর প্রান্তের সেই ব্যাক্তি কোন জবাব দিচ্ছে না দেখে দেব ফোনটা কেটে দিয়ে আবার টি ভির আওয়াজ বাড়িয়ে দেয়। একবার ফোনটা তুলে বুঝবার চেষ্টা করে নম্বরটা কোথাকার। কিন্তু দেবের মনে হল এটা দিল্লি থেকেই কেউ ওকে ফোন করেছিল এবং এই নম্বরটাও এয়ার টেলের নম্বর।

দেব এবার ভাবল এইচ আর থেকে সারকুলার করে দেওয়ায় ওর অফিসের প্রায় সবাই এখন ওর এই নম্বরটা জেনে গেছে। কিন্তু দেব সবার নম্বর জানেনা। এই রাতে ওর কোন কলিগ আবার ওকে কোন জরুরী দরকারে ফোন করল নাতো। হয়ত সিগনালের সমস্যায় উত্তর দিতে পারে নি। দেব প্রায় মিনিট পাঁচেক বাদে এবার আবার টি ভির আওয়াজ কমিয়ে দিয়ে ঐ একই নম্বরে কল ব্যাক করল। প্রথমে দেব কোন ‘হ্যালো’ বা অন্য কিছুই বলল না। ও শুনতে চাইছিল অপর প্রান্তের ব্যাক্তিটি কী বলে দেখতে।

এক মিনিটের বেশি সময় দেব কোন আওয়াজ পেলনা, কিন্তু তবুও উৎসুক হয়ে ফোনটা হাতে ধরে থাকে দেব। ঠিক দেড় মিনিট বাদে ওপার থেকে একটা মিষ্টি গলার আওয়াজ ভেসে এলো, – হ্যালো, তুমি কথা বলছ না কেন ? তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ ? জানো, আমি একটু আগেই তোমাকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু সেটা অন্য একটা ছেলে তুলেছিল তখন। শুধু ‘হ্যালো হ্যালো’ করছিল। আমি তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিয়েছিলাম। তুমি কি এখন কোন বন্ধুর বাড়িতে আছ সোনা ? আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি সোনা। আমি আর কোন দিন তোমার কথার অবাধ্য হবোনা। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও …।’

ফোনেই মেয়েটির কান্নার আওয়াজ পেলো দেব। বুঝতে পারল মেয়েটি তার স্বামী বা বয় ফ্রেন্ডের জন্য ফোনটা করেছিল। কিন্তু এই নম্বরটা যে এখন দেবের নম্বর সেটা মেয়েটা জানে না। ভাবছে সেই লোকটারই নম্বর এবং এই পাড়ে সেই ওর সাথে কথা বলছেনা। দেব একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। কী করবে এখন ? হঠাৎ দেব লাইনটা কেটে দিয়ে চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকে। একটু বাদেই আবার সেই নম্বর থেকে ফোন এলো, – হ্যালো, সোনা। তুমি কোন কথা বলছ না কেন ? আজ প্রায় একমাস বাদে তোমার নম্বরে তোমাকে পেলাম আমি। এর আগে রোজ কেবল বিপ বিপ শব্দ শুনেছি। ভাবলাম তোমার এই নম্বর হয়ত বিজি বা কোন কারণে নট রিচেবেল হবে। আজ যখন পেলাম তুমি কথা বলছ না কেন সোনা ? আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি জানি, এবার আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। আমি কথা দিচ্ছি তোমার কথা মেনেই চলব। তুমি একবার আমার সাথে কাল দেখা কর প্লিজ।’

আধুনিক যুগের ছেলে দেবের মাথায় হঠাত একটা বুদ্ধি খেলে যায়। ও কোন কথা না বলে লাইনটা কেটে দিয়ে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিলো। লিখল – আমি এখন বিজি, কথা বলতে পারছি না। তুমি কাল কোথায় দেখা হবে জানিয়ে আমাকে ম্যাসেজ করে দাও। আমি ঠিক সময়ে চলে আসব কথা দিলাম।’

ম্যাসেজটা পাঠিয়ে দিয়েই দেব মেয়েটির হোয়াটস এপে চেক করে দেখল মেয়েটির নাম শেফালি। ওর প্রোফাইলে একটা দারুণ সুন্দর ছবি দেওয়া আছে। বড় বড় টানা চোখের দৃষ্টিতে স্বপ্নের আভাস। মাথায় ঘন কালো চুলের ফেদার কাট হেয়ার স্টাইল করা মেয়েটি দেখতে সত্যিই ভীষণ সুন্দরী। দেব ওর ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল যখন ঠিক তখনই একটা ম্যাসেজ ঢুকল ওর ফোনে। দেব তাড়াতাড়ি ম্যাসেজটা ওপেন করে দেখে শেফালি একটা লাভ ইমোজির সাথে লিখেছে – কাল ঠিক বেলা পাঁচটার সময় দিল্লি কালী বাড়িতে চলে এসো। আমি ওখানেই বারান্দার বাঁ দিকে বসে থাকব তোমার আশায়। আর যদি না আসো তবে আর কোনদিন আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করব না।’   

পরদিন শনিবার। দেব আই টি সেক্টরের লোক। ওর শনি রবি দুদিন ছুটি থাকে। একেই অবিবাহিত তার ওপর বোনের পরেই বাড়ি থেকে ওর বিয়ের জন্য চাপ আছে, এদিকে ওর কোন গার্ল ফ্রেন্ডও নেই। দেব ঠিক করে ফেলল দেখাই যাক না এই মেয়েটার সাথে আলাপ পরিচয় করে এর সমস্যার সমাধান করে দিলে হয়ত দিল্লিতে ওর একটা বন্ধু তৈরি হয়ে যাবে। না হলে এই অপরিচিত শহরে চিত্তরঞ্জন পার্কে ওর মামারা ছাড়া দেবের তো আর তেমন কেউই নেই যার সাথে সময় কাটানো যায়। আজকালকার ছেলে দেব, কলকাতার ওর বন্ধু সার্কেলটাকে এই নতুন চাকরি নিয়ে এখানে এসে খুব মিস করছে। ওর অবস্থা যেন সেই আফ্রিকার জঙ্গল থেকে চিতা বাঘকে এনে আমাদের মধ্য প্রদেশের অচেনা এক জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার মত, সবই অপরিচিত মুখ।

আপাতত কোন কাজ কম্ম নেই। সকালে উঠেই দেব টিফিন সেরে বেরিয়ে গেল ওর এয়ারটেলের সেই দোকানে, যেখান থেকে এই সিম কার্ডটা কিনেছিল। দেব গিয়ে যখন পৌঁছায় তখন দোকানটা খালিই ছিল। দেব গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, – আচ্ছা আপনাদের দোকান থেকে এই যে সিম কার্ডটা আমি কিনেছিলাম সেদিন তার নম্বরটা আগে যেই ভদ্রলোকের ছিল তার নাম ঠিকানা কি পেতে পারি ? কারণ তার অনেক কল আসছে আমার কাছে। আমি তাহলে ওর নতুন নম্বরটা যদি দেন তো সেটাই ওদের সবাইকে দিয়ে দেব।’ দেবের উদ্দেশ্য ছিল সেই লোকটা বা ছেলেটাকে আজ বিকেলে কালী মন্দিরে যাবার খবরটা দিয়ে ওর সাথে আলাপ পরিচয় করে বন্ধুত্ব করে ফেলা।

যুবক ছেলেটি ওদের কম্পিউটার চেক করে জানাল এই নম্বর আগে ছিল কোন এক বিশাল চ্যাটার্জি নামের লোকের। ছেলেটা দেবকে বিশালের বাড়ির ঠিকানাও দিয়ে দেয়। তবে ওর নতুন নম্বর কিছু আছে কিনা সেটা বলতে পারল না। দেব ছেলেটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা অটো রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে গেল রাজেন্দ্র প্লেসের বিশালের সেই বাড়ির ঠিকানায়।

সেখানে ভদ্র পরিবেশে বিশালদের একতলা বাড়িটা খুঁজতে গিয়েই হোঁচট খেতে হল দেবকে। বিশালদের বাড়ির কয়েকটা বাড়ির আগেই একটা মুদির দোকানে জিজ্ঞাসা করে দেব জানতে পারল বিশাল এক মাস আগে একটা মোটর সাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গেছে। ছেলেটা নাকি একটা ভালো মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে সেলস ম্যানেজার ছিল। বিশালের বাড়ির লোকেরাও ওর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ওদের বাড়ি বেঁচে দিয়ে মেদিনিপুরের বাড়িতে ফিরে গেছে। এখন ঐ বাড়ির নতুন এক সিন্ধ্রি মালিক এসেছেন। বিশালের বাবা মা আর ছোট ভাই কেউই আর দিল্লিতে থাকে না।

দেব আকাশ থেকে পড়ল। বেশ বুঝতে পারল বিশালের এক্সিডেন্টে মৃত্যুর এই মর্মান্তিক খবরটা শেফালি নামের মেয়েটি নিশ্চয়ই জানতে পারেনি। আর শেষ যেদিন ওদের দেখা হয় সেদিন নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে কোন একটা কারণে ঝগড়া বা ভুল বোঝাবুঝি কিছু একটা হয়েছিল তাই মেয়েটি বারবার বিশালের কাছে মাফ চাইছিল কাল। দেব চিন্তায় পড়ে গেল। এবার ও কী করবে ? কোন মুখ নিয়ে শেফালিকে বলবে যে বিশাল আর নেই। দেব তো জানেও না ওদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা কতোটা গভীরে ছিল। কথা বলে জানা গেল বিশাল অবিবাহিত ছিল। তার মানে এই মেয়েটি নিশ্চয়ই বিশালের প্রেমিকা, যার সাথে হয়ত কিছুদিন বাদেই বিয়ে হতে পারত বিশালের।

চিন্তিত দেব ফিরে এলো ওর আজমল খান রোডের ফ্ল্যাটে। লাঞ্চের পর বিছানায় শুয়ে রেস্ট নেবার সময় অনেক চিন্তা ভাবনা করে দেব ঠিক করল ও মেয়েটির সাথে দেখা করে ওকে সব বুঝিয়ে বলবে। তারপর মেয়েটি যা ভাল বুঝবে তাই করবে। একটা যুবতী মেয়েকে তার প্রেমিকের নম্বরের ফোন রিসিভ করে এতো করুণ মিনতির কথা শুনে কেন জানি দেবের মেয়েটির উপর একটা মায়া জন্মে গেছিল। বেচারি তো জানেই না যে ওর প্রেমিক বিশাল আর এই ইহ জগতেই নেই। সে আর কোনদিনই ফিরে আসবে না। হয়ত বিশালের কাছ থেকে মার্জনা ভিক্ষা করে মেয়েটি নিজের মনকে শান্ত করতে চাইছে। ওকে সত্যিটা জানাতেই হবে। এই কারনেই হয়ত শেফালি মেয়েটি বিশালের নম্বরে বার বার ফোন করে চলেছে। আর আজ না জেনেই দেবকে কাল দেখা করতে বলে দিয়েছে। এবার দেব সেখানে না গেলে আবার এই শেফালির মনে সন্দেহ, হতাশা এবং ক্ষোভ দানা বাধবে এবং তার পরিণতিতে মেয়েটি আত্মহত্যাও করতে পারে।   

দিল্লির কালী বাড়ি একটা বিখ্যাত জায়গা দেব শুনেছিল। অনেক দিন যাবতই ভাবছিল একবার গিয়ে মায়ের দর্শন করে আসবে। বিকেল সাড়ে চারটার সময় একটা অটো নিয়ে সেখানে চলে এলো দেব। ঘড়িতে তখন চারটে বেয়াল্লিস বাজে। আজ শনিবারের ভিড় আছে। দেব মন্দিরে ঢুকে মায়ের প্রতিমা দর্শন করে নমস্কার করে চারিদিক ঘুরে দেখে নিয়ে সামনের বারান্দার ডান দিকে গিয়ে বসে রইল। দেবের বয়স এখন তিরিশ। বাড়িতে সামনের শীতেই বোনের বিয়ের আয়োজন চলছে। এরপর দেব ভেবে রেখেছে দিল্লিতে ভাল লাগলে কলকাতার বাড়ি বেঁচে দিয়ে বাবা মাকে নিয়ে এখানেই একটা ফ্ল্যাট কিনে চলে আসবে। কলকাতার আবহাওয়া বা পরিবেশ এখন আর ভাল লাগে না ওর। তার উপর রাজনৈতিক ঝামেলা, চুরি চামারি, বোমা বাজি, খুন এসব তো লেগেই আছে। দেবের দিল্লির রাস্তাঘাট ও পরিবেশ দারুণ লাগে। দিল্লি আসবার পর মাঝে একবার চিত্তরঞ্জন পার্কে ওর মামা বাড়িতে গিয়ে দেখাও করে এসছে দেব। দারুন জায়গায় ওর মামা বাড়িটা। 

এটা মার্চ মাস। দিল্লিতে এখন ভীষণ গরম চলছে। দুপুরে বাইরে লু ছোটে, বের হওয়ায় যায়না। যদিও বিকেলের পর আবহাওয়া বেশ ভাল হয়ে যায়। ঠিক পাঁচটা দশে  নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরা সুন্দরী যুবতী শেফালি এসে ঢুকল মন্দিরে। দেব দেখেছে ওকে, কিন্তু চুপচাপ বসে দেখতে থাকে মেয়েটা এবার কী করে। দেব শেফালি চটি ছেঁড়ে মন্দিরের দিকে এগোচ্ছিল যখন তখনই ওকে দেখে চিনতে পেরে যায়। একদম ফটোর সেই মুখটা। শেফালি দেবকে লক্ষ্য করেনি। মন্দিরে ঢুকে আগে মায়ের প্রণাম সেরে শেফালি এসে বসল বারান্দার বাঁ দিকে মন্দিরে ঢোকবার রাস্তার দিকে মুখ করে। ওর চোখ মুখে একটা আশা হতাশার ছোঁয়া পরিষ্কার দেখতে পেলো দেব। ওর প্রেমিকের এক্সিডেন্টের মৃত্যুর কথাটা ভেবেই শেফালির জন্য দেবের মনটা কেঁদে উঠল।

দেব এবার উঠে দাঁড়ায়। গরমের বিকেল, এখন ফুরফুরে হাওয়া বইছে। দেবের পরনে কালো জিন্স আর একটা আকাশী রঙের টি সার্ট, পায়ের স্পোর্টস শু মন্দিরেরে জুতো রাখবার জায়গায় রেখে এসেছে। মাথার ঘন চুলগুলি ঠিক করে নিয়ে দেব এগিয়ে গিয়ে শেফালির কাছাকাছি এসে বসল একটু দুরত্ব বজায় রেখে। শেফালি একবার ওর দিকে তাকিয়েই আবার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দেব আরও কনফার্ম হবার জন্য টি সার্টের পকেটে রাখা ওর সেল ফোন বের করে শেফালির নম্বরে ফোন লাগায়। সাথে সাথে শেফালির রিং টোন শোনা যায়। শেফালি ওর হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ বের করে বিশালের নম্বর দেখে ফোন তুলেই বলে, – হ্যালো সোনা। তুমি কোথায়। আমি তো এসে গেছি এখানে। তুমি কোথায় এখন ?’

বিশাল সোজা সুজি শেফালিরে দিকে তাকিয়ে ফোনেই বলল, – এই যে আমি এখানেই বসে আছি ম্যাডাম, আপনার সামনেই। আমার নাম দেব, দেবদূত মৈত্র। এটা বিশালের নম্বর ছিল, কিন্তু এটা এখন আমারই নম্বর। আর কাল আপনার ফোন আমিই তুলেছিলাম।‘ দেব ফোনটা না কেটে শেষ কথাটা বলল। শেফালি মুখ ঘুরিয়ে ফোন কানে লাগানো দেবের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে, – তার মানে ? আপনি কে ? আপনাকে তো আমি কোনদিন দেখিনি ! বিশাল কোথায়, ও কেন আসেনি আজ ? বিশাল কি এখনো আমার উপর রেগে আছে যে আপনাকে পাঠিয়েছে ?’ কথাটা বলতে গিয়ে শেফালির চোখে জল চলে এলো। ভিতরে ভিতরে অভিমানে গুমরে কেঁদে উঠল যেন।

দেব এবার একটু চুপ করে রইল। ওর সত্যি কথাটা জানাতে ভীষণ দ্বিধা হচ্ছে তখন। কি করে একটা তরতাজা যুবকের এক্সিডেন্টে মৃত্যুর খবর নিজ মুখে তারই প্রেমিকাকে দেবে সেটা ওর হঠাত মুখে আসছিল না। দেবকে চুপ দেখে শেফালি আরও বেশি চিন্তিত হয়ে বলে উঠল, – আপনি চুপ করে আছেন কেন ? বিশাল কোথায় ? কী হয়েছে বিশালের ? ও ঠিক আছে তো ? কাইন্ডলি বলুন আমাকে। আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ…।’ কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে এলো মেয়েটির গাল বেয়ে। 

দেব শেফালির চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। মাথাটা নিচু করে বলল, – আই এম ভেরি সরি ম্যাডাম, বিশাল এক মাস আগেই একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমি আজই সকালে এয়ারটেল অফিস থেকে ওর ঠিকানা জোগাড় করে গেছিলাম ঐ ঠিকানায় গিয়ে ওকে আপনার ম্যাসেজটা জানাতে। কিন্তু বিশালের পাড়ায় গিয়ে জানলাম সব কথা। ওর বাড়ির সবাই বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছে ওদের দেশের বাড়িতে। এই নম্বরটা আমাকে এয়ারটেল থেকে ইসু করেছিল। তাই আমি নিজেই আসলাম আপনাকে এই দুঃসংবাদটা দিতে। আপনি আমাকে বিশ্বাস না করলে নিজে এবার খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে পারেন। আমি আপনাকে ওর ঠিকানা দিয়ে দেব।‘ দেব বুঝতে পেড়ে গেছিল যে শেফালি হয়ত কোনদিনই বিশালের বাড়িতে যায়নি বা ওর ঠিকানাটা জানতো না।

শেফালি বিশাল এক্সিডেন্টে মারা গেছে শুনেই চমকে উঠেছিল। এরপর ওর বাবা মা সবাই দেশে চলে গেছে শুনেই বুঝতে পেরে যায় যে এই লোকটা সত্যি কথাই বলছে। ওর ভিতরে একটা ভূমিকম্প হয়ে গেল যেন। এক মুহূর্ত মাথা নিচু করে নিজেকে সামলে নিল শেফালি। রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে তাকাল দেবের দিকে। কান্না ভেজা মিষ্টি গলায় বলল, – আপনার কাছে বিশালের এই নম্বরটা গেছে আমি জানতাম না। তাই কালকে দুবার ফোন করেছিলাম। এর আগে রোজই এই নম্বরে ট্রাই করেও পাইনি। আপনি আমার সাথে দেখা করে বিশালের খবরটা না দিলে আমি কোনদিন আর জানতামই না যে সে এখন এই দুনিয়াতেই আর নেই। শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন বিশাল আর আমার মধ্যে খুব ঝগড়া হয়েছিল। তখন কি জানতাম ও আর…’। পুরো কথাটা শেষ হয়না। শেফালি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

দেবের ভীষণ খারাপ লাগছিল। একটু কাছে ঘেঁসে এসে শেফালির কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, – আমি বেশ বুঝতে পারছি আপনার কষ্টটা। যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে কী নিয়ে আপনাদের ঝগড়া হয়েছিল সেটা আমাকে শেয়ার করতে পারেন। তাতে আপনার মনটা বোধ হয় একটু হাল্কা হতে পারে।’

শেফালি এবার ওড়না দিয়ে চোখ মুখ মুছে দেবের দিকে তাকিয়ে বলল, – আসলে আমি ভারত নাট্যম শিখি, এবার আমার ফাইনাল ইয়ার। সামনের জুলাই মাসে আমাদের দলটা যাচ্ছে জাপানে একটা ফাংশনে নৃত্য পরিবেশন করতে। আমি সেই ট্যুরে সেদিন আমার যাবার ব্যাপারটা বিশালকে জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু বিশাল সেটা মানতে পারেনি। ওর বক্তব্য ছিল ওকে না জানিয়ে আমি জাপান যাবার মত দিলাম কী করে। আমার জাপান যাওয়া নিয়েই আমাদের সেদিন খুব অশান্তি হয়েছিল তাই। সেদিন আমি ওকে বলেছিলাম আমি জাপানে যাবই। এতো বড় সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে পারব না। তাতেই ও খুব রেগে গেছিল। এরপর আমিও ভাবছিলাম আর যাবো না। তাই আমি বিশালের কাছে মাফ চাইছিলাম ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলবার জন্য।’

দেব এবার বুঝতে পারল ওদের দুজনের মনোমালিন্যের কারণটা। একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, – তা এবার আপনি কী করবেন ভাবছেন ? আপনি কি সত্যিই জাপানে যাবেন না, নাকি এখন যাবেন ভাবছেন ?’

শেফালি দেবের মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে ওর মনের ভিতরে উঁকি মেরে এই হ্যান্ডসাম ভদ্র ছেলেটাকে বুঝবার চেষ্টা করতে থাকে। দেব ওর তাকানো দেখেই বুঝে যায় ওর মনে কী চলছে। বলে, – আমি দিল্লিতে এসেছি মাত্র দিন পনের হল। এখানে একটা বিদেশী সফটওয়ার কোম্পানিতে চাকরি করছি। ভবিষ্যতে কলকাতা থেকে বাবা মাকেও নিয়ে আসবার প্ল্যান আছে। আপাতত আজমল খান রোডে অফিসের দেওয়া একটা ফ্ল্যাটে থাকি। ব্যাচেলর মানুষ, বাইরে হোটেলে খেয়ে মোটামুটি চালিয়ে নিচ্ছি। মদ বা সিগারেট খাইনা। এর চেয়ে বেশি আর কিছু জানাবার নেই আমার।’   

শেফালি দেবের পরিচয় পেয়ে বিশেষ কিছু প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করল, – আপনি আমার জায়গায় থাকলে কী করতেন, যেতে জাপানে ? প্রেমিকের মারা যাবার খবর জেনেও যেতেন ?’

দেব শেফালির কাঁধ থেকে ওর হাত সরিয়ে এনেছিল আগেই। এবার হাওয়ায় উড়তে থাকা নিজের মাথার এলোমেলো চুলগুলি ঠিক করতে করতে বলল, হ্যাঁ, আমি যেতাম। কারণ যেই লোকটা দুনিয়া থেকেই চলে গেছে, তার জন্য একজনের জীবনের অগ্রগতির পথ থেমে যাবে কেন ? আমি এগিয়ে চলায় বিশ্বাসী, পিছন দিকে তাকিয়ে হা হুতাশ করায় বিশ্বাসী নই। আপনি সেটা মানুন বা না মানুন, সেটা আপনার ব্যাক্তিগত ব্যাপার।’

দেবের এই একটা কথা সেদিন শেফালির ভীষণ ভালো লেগে গেছিল। ঠিক এক সপ্তাহ বাদে সেই একই জায়গায় দেখা গেল শেফালি আর দেবকে। দেব এখন শেফালিকে তুমি করে বলে। দেবের সাথে এই ক’দিন ফোনে চ্যাটিং করে শেফালিও নিজেকে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছে। দেব শেফালিরে সেল ফোন নাড়াচাড়া করতে করতে ওকে জিজ্ঞাসা করল, – তোমার ফোনে আমার নম্বরটা এখনো দেব নামে  সেভ করনি কেন জানতে পারি ? শেফালি ফিস ফিস করে জবাব দেয়, – করিনি কারণ তুমিই আমার বিশাল। ভগবান তোমাকেই আমার কাছে বিশালের দেবদূত করে পাঠিয়েছেন এই মন্দিরে। এখন থেকে বিশালের জায়গাটা শুধু তোমাকেই দিলাম আমি। আমার সাথে একসাথে পথ চলবে দেব ?’

                  ——–শেষ——–

Photos : Google.