ক্ষতিপূরণ    (ছোট গল্প)       – উত্তম চক্রবর্তী।

‘বলাই সামন্ত মারা গেছে ? বলেন কী আপনি ! আমিতো পরশু দিনও ওকে দেখলাম একটা সাইড ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ষ্টেশনের দিকে যেতে। আপনি আবার অন্য কারও খোঁজ করছেন নাতো ?’ বলাই সামন্তর খোঁজ নিতে আসা এক সরকারী অফিসারের প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করল বলাইয়ের পাড়ার বন্ধু প্রদীপ ঘোষ। সরকারী অফিসার এসেছেন তদন্ত করতে যে বলাই সামন্ত কবে এবং ঠিক কী কবে মারা গেছেন জানতে। কিন্তু উনি কেন এটা জানতে চাইছেন বা বলাইয়ের মৃত্যুর খবর উনি কোথায় পেলেন সেটা কিন্তু ভেঙ্গে বললেন না।

সরকারী অফিসার ঘনশ্যাম দাস হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি বলাই সামন্তর ব্যাপারেই জানতে চাইছি। তা আপনি ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সে কোথায় চলল ? কবে ফিরবে ?’ 

প্রদীপ জবাবে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি জানতে চাইলে ও তো বলল কয়েকদিনের জন্য ব্যাবসার কাজে টাটানগর যাচ্ছে। বলাই একটা ছোট খাট ব্যাবসা করে জানেন বোধ হয়। বলল এক সপ্তাহ বাদেই ফিরবে।’ রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথাটা বলে প্রদীপ আবার নমস্কারের ভঙ্গি করে এগিয়ে যায় ওঁর গন্তব্য বাজারের পথে। তবে যাবার আগে অফিসারকে বলল,‘ঐ তো বলাইয়ের বাড়ি, ঐ লাল রং করা একতলা বাড়িটা। যান না গিয়ে ওঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন, সেই সব বলে দেবে।’

আসলে বড় বাজারে আগরওয়াল বিল্ডিঙ্গে গতমাসে যে ভয়াবহ আগুন লেগে প্রায় প্রায় চল্লিশ জনের মৃত্যু হয়েছিল, তারপরেই রাজ্য সরকার প্রত্যেক মৃতের পরিবারকে দশ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারের একজনকে চাকরি দেবে ঘোষণা করে। অনেক মৃতের পরিবার থেকেই মৃতের কোন ঘনিষ্ঠ মানুষ এসে তাদের পরিচয় দিয়ে সরকারী অনুদানের জন্য, কেউবা সাথে ছেলে বা মেয়ের একটা চাকরির জন্য আবেদন করেছে। বলাইয়ের স্ত্রী সন্ধ্যা সামন্ত তাদের মধ্যে একজন যিনি তার সেই দশ লাখ টাকা অনুদান দাবি করেছে।

বড় বাজারের সেই ভয়াবহ আগুনে যেই চল্লিশ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তাদের চেহারা এতোটাই পুড়ে গেছিল যে এদের মধ্যে সাত জনকে কেউই চিনতে পারেনি। মর্গে রাখা সেই মানুষদের লাশগুলির গত পনের দিনে কোন দাবীদার আসেনি। শেষে পরশু দুপুরে সন্ধ্যা সামন্ত নামের এক মহিলা এসে মেডিক্যাল কলেজের মর্গে রাখা একটা সম্পূর্ণ জ্বলে যাওয়া লাশ দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে আর আঙুল কাটা দেখে জানায় যে সেটা ওরই স্বামী বলাই সামন্তর লাশ। বলাইয়ের নাকি ঐ আগরওয়াল বিল্ডিঙে মনিহারীর ব্যাবসার জিনিষ পত্র কিনতে যেত। ঐদিনও বলাই গেছিল ওঁর মালপত্র কিনতে।

সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অফিস থেকে দেওয়া ফর্ম ফিল আপ করে,দুজনের আধার কার্ডের জেরক্স কপি জমা দিয়ে সন্ধ্যা সামন্ত তার দশ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দাবী করে। বত্রিশ বছরের সন্ধ্যার কোন সন্তান নেই। ওর ভাষায় সন্ধ্যার সাথে দোকানে দোকানে মনিহারী জিনিষের সাপ্লাইয়ের ব্যাবসা করা পাঁচ বছরের বড় বলাইয়ের বিয়ে হয়েছিল বছর সাতেক আগে। মানিকতলার বলাইয়ের পৈত্রিক বাড়িতে খুব কষ্টে ওদের দিন কাটে। সন্ধ্যা নিজেও বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করে সংসারে টাকা দেয়।                                          

মিসেস চন্দ্রানি মণ্ডল, সরকারের ত্রান দপ্তরের উচ্চ পদস্থ অফিসার। পুড়ে যাওয়া মানুষদের মধ্যে সাতটা আন আইডেণ্টিফায়েড লাশের থেকে এতদিন বাদে একজন মহিলা এসে তার স্বামীর মৃতদেহ সনাক্ত করে ত্রাণের দশ লাখ টাকা ক্লেইম করতে এসেছে,তাও আবার অবৈধ পথে কোন রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীর রিকমেণ্ডেশন ছাড়াই,শুনে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলেন। দপ্তরের এক মাঝ বয়সী অফিসার ঘনশ্যাম দাসকে তার কেবিনে ডেকে জানালেন,‘শুনুন দাস বাবু, এই সন্ধ্যা সামন্তর কেসটা আমার কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে। আপনি একটু ওর ঠিকানায় গিয়ে আসেপাশের লোক থেকে ঐ বলাই সামন্তর ব্যাপারে আরেকটু খোঁজ খবর নিয়ে আসুন। এই ব্যাপারটা যেন এই দপ্তরের আর কেউ না জানতে পারে।’

ঘনশ্যাম দাস কিন্তু এরপর বলাই সামন্তর বাড়িতে আর যায়নি। একটু এগিয়ে গিয়ে বলাইয়ের বাড়ির কাছেই একটা মুদির দোকানে গিয়ে একটা সিগারেটের প্যাকেট কিনে বলাইয়ের বাড়ির দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞাসা করলেন,‘এই বাড়িটা সেই বলাই সামন্তর বাড়ি না, যিনি বড় বাজারের সেই আগুনের ঘটনায় মারা গেছিলেন ? ওঁর বাড়িতে এখন কেউ থাকেনা ?’

মুদির দোকানের লোকটা অবাক হয়ে জবাব দিলো, ‘বলাই সামন্ত আগুনে পুড়ে মারা গেছিল কে বলল আপনাকে ? ও তো দিব্যি বেঁচে আছে। এই তো পরশু সকালেও আমার দোকান থেকে ডাল আর মশলাপাতি কিনে নিয়ে গেল। তবে কাল আর আজ অবশ্য আসেনি। কিন্তু ও মরতে যাবে কোন দুঃখে ?’

ঘনশ্যাম দাস লজ্জিত হবার ভান করে বললেন,‘ওহ, তাহলে স্যরি। সে বোধ হয় অন্য আরেক জন বলাই সামন্ত হবেন। কিছু মনে করবেন না। আমি এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম। খবরের কাগজে নাম দেখেছিলাম তো তাই। আমাকে রাস্তায় কে যেন বলল ওটাই বলাই সামন্তর বাড়ি,তাই জিজ্ঞাসা করলাম। ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ বলেই আর কোন কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল। ঘনশ্যাম দাস সোজা চলে এলো অফিসে এবং গিয়ে বসকে জানাল সমস্ত ঘটনা। চন্দ্রানি মণ্ডল মনে মনে ভাবলেন ওঁর সন্দেহই তাহলে একদম ঠিক। বললেন,‘ঐ সন্ধ্যা সামন্তকে ওর সেল ফোনে খবর দিন যাতে কাল সকালে এসে আমার সাথে দেখা করে।’

সন্ধ্যা সামন্ত এক বুক ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে পরদিন সকালে এসে দেখা করল চন্দ্রানি মণ্ডলের সাথে। কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চন্দ্রানি মণ্ডল সন্ধ্যাকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,‘কি, এসব কতদিন যাবত চলছে? আর কোথায় কোথায় এরকম চিটিংবাজি করে টাকা কামিয়েছেন শুনি? আমরা তো সব খবরই পেয়ে গেছি। এবার দেব নাকি আপনাকে জেলে পুরে? বেশ জ্যান্ত মানুষটাকে মড়া সাজিয়ে দিয়ে দশ লাখ টাকা হাতানোর তালে ছিলেন তাই না ?’

সন্ধ্যা সামন্ত মুখ নিচু করে বলল, ‘ম্যাডাম, আমরা খুব গরীব মানুষ। কোনোমতে দিন আনি দিন খাই। কী করব বলুন। সরকারের এই দশ লাখের ক্ষতিপূরণের টাকা পেলে স্বামীর ব্যাবসাটা বাড়ত। কত্তার সাথে আলোচনা করে দুজনে মিলেই এই প্ল্যান করেছিলাম ম্যাডাম। কত্তাকে লুকোবার জন্য ওঁর ভাইয়ের বাড়ি মালদাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি যে আমি ধরা পড়ে যাব।’

চন্দ্রানির মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটে উঠল। নিচু গলায় বললেন,‘এক শর্তে দশ লাখ টাকা পাবে। দেখ ভেবে। আমার শর্ত মানবে না জেলে যাবে।’

সন্ধ্যা ভয়ে ভয়েই বলল,‘কী শর্ত বলুন ম্যাডাম।’

চন্দ্রানি মণ্ডল গলার স্বর যতটা সম্ভব নিচু করে বললেন,‘টাকা পেলে প্রথমেই আমাকে তিন লাখ টাকা এনে দিতে হবে। তাও ক্যাশে দিতে হবে। তুমি যদি তাতে রাজি হও তাহলে আমি আজই তোমার কেসটা এপ্রুভ করে দেব। বল এবার রাজি আছ কিনা ?’

অগত্যা সন্ধ্যা সামন্ত বাধ্য হয়েই রাজি হল। বলল,‘ঠিক আছে ম্যাডাম। আমি রাজি। কেউ জানবে না তো ?’  

চন্দ্রানি বললেন,‘জানবে শুধু আমার একজন অফিসার। অবশ্য তাকেও আমাকে টাকা দিতে হবে মুখ বন্ধ রাখবার জন্য। তাহলে ঐ কথাই রইল সন্ধ্যা। দুদিন বাদে এসে চেক নিয়ে যেও।’

দুই দিন বাদে দশ লাখের চেক হাতে পাবার আরও চারদিন পর সন্ধ্যা এলো পর ওকে কেবিনে ডেকে দরজা আটকে চন্দ্রানি মণ্ডল তার হাত থেকে তিন লাখ টাকার প্যাকেটটা নিয়ে সেখান থেকে এক লাখ টাকা সরিয়ে রাখলেন ঘনশ্যামের জন্য। সবাইকেই তো খুশি রাখতে হবে, তাই না ?

                      ————শেষ————

* এই গল্পটি কলকাতা থেকে ১৪৩০ এর শারদীয়া “গ্রন্থসাথী” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।