বিলম্বিত প্রেম          – উত্তম চক্রবর্তি।  ব্যাঙ্গলোর।      

পাপিয়ার মা মনোরমা দেবী মারা গেলেন যখন ওর বয়স পনের, ঠিক ওর  স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পরেই। একটা সরকারি স্কুলের ইংরাজির শিক্ষিকা ছিলেন উনি। পাপিয়ার বাবা অচিন্ত্য সান্যাল কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল হাইওয়ে কমিশনে কলকাতা দপ্তরে উঁচু পোস্টে চাকরী করেন। নিউ আলিপুরে নিজের দোতলা বাড়ি। একটাই মেয়ে পাপিয়া অচিন্ত্য বাবুর ভীষণ প্রিয়। যদিও পাপিয়ার আগে এক ভাই অর্থাৎ অচিন্ত্য বাবুর বড় ছেলে পল্লবকেও উনি ভালোবাসেন।

পল্লব বি টেক পাশ করে একটা আই টি কোম্পানিতে চাকরী করে। পাপিয়া হাই স্কুল পর্যন্ত পড়ে আর কলেজে ভর্তি হয়নি। একদিকে দাদা ওর কলেজ নিয়ে ব্যস্ত, আরেকদিকে বাবা সকালে উঠেই অফিস চলে যান। পাপিয়া সংসারের যাঁতাকলে পড়ে বাড়িতেই থাকত বেশিক্ষণ। শুধু বিকেলে ওর গানের স্কুলে যেত রোজ সংগীত প্রভাকর কোর্স কমপ্লিট করবার জন্য। শেষে পল্লব চাকরী পাবার পর পাপিয়াও ওর সঙ্গীত প্রভাকর ফাইনাল দিয়ে এলাহাবাদ থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করবার সার্টিফিকেট হাতে পেল।

পল্লব একজন কায়স্থ মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ের অনুমতির জন্য বাবার সাথে কথা বলে। পল্লবের হবু স্ত্রী মহয়াকে অচিন্ত্য সান্যাল কিন্তু মেনে নিতে পারলেন না। কঠিন পাথরের মত বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন ওদের ভালোবাসার স্রোতের সামনে। পল্লবের সাথে অচিন্ত্য বাবুর এই বিয়ে নিয়ে কয়েকদিন কথা কাটাকাটি হবার পর উনি বিয়েটা মেনে নিলেন ঠিকই কিন্তু পল্লবকে অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে বলে দেন। বেচারি পল্লব বাধ্য হয়েই ওর ভালোবাসাকে সম্মান দিয়ে নিউ আলিপুরেই একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে মহুয়াকে সেই বাড়িতেই নিয়ে তোলে।

সংসারে এরপরেই পাপিয়া একদম একা হয়ে যায়। এখন এতো বড় বাড়িতে শুধু পাপিয়া আর ওর বাবা। অচিন্ত্য বাবু মেয়ের কথা ভেবেই বাড়ির নিচতলাটা ভাড়া দিয়ে দিলেন। দোতলায় ঘরের কাজের ঝি ও রান্নার লোক সকালেই এসে সব কাজ কর্ম করে দিয়ে যায়। পাপিয়া ওর গান আর বই পড়া নিয়েই সময় কাটায়। দেখতে দেখতে আরও পাঁচ বছর কেটে যায়। পল্লব এবং অচিন্ত্য বাবুর বন্ধুরা অনেকেই পাপিয়ার বিয়ের জন্য সম্বন্ধ আনতে শুরু করে। কিন্তু অচিন্ত্য বাবুর কোন সম্বন্ধই পছন্দ হয়না। পাপিয়া একটু শান্ত স্বভাবের মেয়ে। ওর গায়ের রঙ চাপা হলেও মুখটা ভীষণ মিষ্টি, একদম ওর মায়ের মতন। পাপিয়ার বয়স যখন বত্রিশ তখনই রিটায়ারের ঠিক আগে একদিন হার্ট এটাক করে মারা গেলেন অচিন্ত্য সান্যাল।    

বাবার এই আকস্মিক মৃত্যুতে দুই ভাই বোন ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়ল। পল্লব ভালভাবেই বাবার শেষ কাজ সম্পন্ন করে। এরপরেই পল্লব জানতে পারে যে বাবা যেই উইল করে গেছেন তাতে উনি এই এতো বড় বাড়িটাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। এর একভাগ, মানে এক তলার একটা অংশ দিয়েছেন পল্লবকে, আর বাকি একতলার ওনার নিজের অংশ এবং সম্পূর্ণ দোতলাটা দান করে গেছেন পাপিয়ার নামে। পল্লব বেশ বুঝতে পারে ওর স্বর্গত বাবা মাহুয়াকে মেনে নিতে পারেননি বলেই পল্লবের উপর রাগ ও অভিমান করে ছেলেকে শুধুমাত্র বংশধর হিসাবে ওঁর এই সম্পত্তির এই একটা অংশ লিখে দিয়ে ওঁর কর্তব্য করে গেছেন। যদিও পল্লব আলাদা একটা ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছে চার বছর আগেই। অচিন্ত্য সান্যাল ছেলের সম্পত্তি নিয়ে চিন্তিত না হয়ে মেয়েকে বেশি অংশ দান করে ওকে সুরক্ষিত করে গেছেন। তাছাড়া ওর বাবা মা দুজনের পেনশনও পাপিয়াই পাচ্ছে এখন অবিবাহিতা মেয়ে হিসাবে। নিচের পল্লবের অংশ অনেকদিন যাবত তালা মারা অবস্থায় পড়ে আছে।

পল্লব ওর বোনকে যথেষ্ট ভালোবাসে। পল্লবের এক মেয়ে ও এক ছেলে, ওরাও পিসিকে ভীষণ ভালোবাসে। দিন যায়, একই বৃক্ষের শাখা প্রশাখার মত সবাই বেড়ে ওঠে। পল্লব ছুটির দিনে বাড়িতে এসে বাজার হাট করে খাওয়া দাওয়া করে সারাদিন হই হই করে কাটিয়ে যায়। বাড়িতে সারাদিন একা একা বসে পাপিয়া যে একাকীত্বের যন্ত্রণা ভোগ করে তার থেকে ওকে যতটা মুক্তি দেওয়া যায়। যদিও পল্লব এখনো পুরো-দমে বোনের বিয়ের জন্য সম্বন্ধ দেখা চালিয়ে যাচ্ছে। এই চল্লিশ বছর বয়সে পাপিয়া আছে ওর গানের জগত নিয়ে। সকাল বিকেল অনেকগুলি গানের টিউশনি করে সময় কাটায় পাপিয়া। বয়সের ভারে ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে পাপিয়ার চেহারাও অনেক বদলে গেছে। পাপিয়াকে এখন আগের চেয়েও বেশ মোটা দেখায়। শুধু ওর মুখটাই ভীষণ সুন্দর আছে এখনো।

পল্লবদের পাড়ার মহিম চৌধুরী হচ্ছেন একটা সরকারি ব্যাঙ্কের অফিসার। আগে থাকতেন বনগাঁয়, সেখান থেকে কাছেই বেহালাতে ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন আর পল্লবদের পাড়ায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সপরিবারে থাকেন। নিজের স্কুটারে অফিস যাতায়াত করেন মহিম চৌধুরী পল্লবদের বাড়ির সামনে দিয়েই। পাপিয়া সেই সময় ওর সবার ঘরের জানলায় বসে উদাস মনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মহিম চৌধুরী রোজই দেখেন মেয়েটিকে শুধু যাবার সময়।

মহিম চৌধুরীর মেয়ে কুহু কাছেই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ে। মেয়ে খুব ভালো গান গায় দেখে মহিম চৌধুরী মেয়েকে গান শেখাবেন বলে একটা দামী হারমোনিয়াম কিনে ভাল একজন গানের শিক্ষিকার খোঁজ করতে থাকেন। শেষে এক রবিবার সকালে খোঁজ খবর নিয়ে পৌঁছে যান পাপিয়াদের বাড়িতে। মহিম বাবু কুহুকে নিয়ে দোতলায় গিয়ে হাজির হন। এইভাবেই পাপিয়ার আরেকটা ছাত্রী জুটে যায়। মহিম বাবুর স্ত্রী রোজ বিকেলে মেয়েকে নিয়ে পাপিয়ার কাছে ছেড়ে দিয়ে চলে যান আর আবার এক ঘণ্টা বাদে এসে নিয়ে যান ওকে। 

এল টি এ নিয়ে পূজোর পরেই মহিম বাবুরা চলে গেলেন হরিদ্বার বেড়াতে। ওদের সবার অদেখা হরিদ্বার আর হৃষীকেশ হল এবারের গন্তব্য। হরিদ্বারে তিন দিন থেকে গঙ্গা স্নান, রোপ ওয়েতে গিয়ে মনসা মন্দির দেখা, সন্ধ্যা বেলার গঙ্গারতি দেখা সবই হল। শেষে ওরা তিনজন গিয়ে উঠলেন আরও ওপরে হৃষীকেশে। মহিম বাবু আগে থেকেই ট্রেনের টিকিট ও হোটেল বুক করেই কোথাও বেড়াতে বের হন। সুতরাং হৃষীকেশে ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। আসে পাশের মন্দির দর্শন ও গঙ্গা স্নান করে দুদিন কেটে গেল। তৃতীয় দিন ওদের বিকেলে হরিদ্বারে নেমে আসবার কথা ও রাতের ট্রেনে ফেরার টিকিট কাটা আছে। সেদিন সকালেই গঙ্গা স্নান করতে গিয়ে হল একটা বড় দুর্ঘটনা।

ওদের হোটেলের সামনেই যাবার আগে শেষ বারের মত গঙ্গা স্নান করতে গেছিল মহিম বাবু এবং ওঁর পরিবার। ঠাণ্ডা জলে কেউই বেশি গভীরে যেতে চাইছিল না। তাছাড়া হৃষীকেশের গঙ্গা ভীষণ খরস্রোতা আর পাড়ের চারিদিকে টুকরো টুকরো পাথরে ভর্তি। মহিম বাবু পাড়ের দিকে মুখ করে ডুব দিচ্ছিলেন। গীতা ও কুহু একটু নিচের দিকে চলে গেছিল। হটাত কুহুর হাত ছুটে যায় আর জলের স্রোতে কুহু ভেসে যেতে থাকে। গীতা চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুহুকে বাঁচাতে কিন্তু সেই ভীষণ স্রোত গীতাকেও টেনে নিয়ে যায়। জলের থেকে মাথা তুলে হটাত মহিম বাবু তাকিয়ে দেখেন ওঁর স্ত্রী গীতাকে আর আদরের মেয়ে কুহুকে মা গঙ্গা তার বুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। মহিম বাবু ওদের বাঁচাবার জন্য চিৎকার করতে করতে এগতে চেষ্টা করতেই আসে পাশের কয়েকজন লোক ওকে ধরে ফেলেন। নাহলে মহিম বাবুকেও হয়ত ঐ ভীষণ খরস্রোতা নদী সেদিন টেনে নিয়ে চলে যেত অজানার উদ্দেশে।

ভগবান এদেরকে এতদূরে নিয়ে এসে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। মহিম বাবুর চোখের সামনে গীতা আর কুহু ওকে চিরকালের মত ছেড়ে নদীর জলে ভেসে গেল। পুলিশ অনেক খোঁজা খুঁজির পর বিকেলে প্রায় চার কিলোমিটার দুরে মা মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করল। দুজনকে হৃষীকেশেই দাহ করে আরও দুদিন বাদে কলকাতায় ফিরে এলেন হতভাগ্য মহিম বাবু।

চাকরী ছাড়েননি মহিম বাবু। কিন্তু অতো বড় ফ্ল্যাট আর রেখে লাভ নেই বলেই ফ্ল্যাট ছাড়বার প্ল্যান করতে থাকেন। খবর পান যে ওঁর মেয়ের দিদিমণির বাড়ির একতলায় ভাড়াটে উঠে গেছে। মহিম বাবু এসে পাপিয়ার সাথে দেখা করে আগে ওকে সেই দুঃখের কথাটা জানালেন। পাপিয়া কুহু আর নেই শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওর খুব আদরের ছাত্রী ছিল মেয়েটা। শেষে মহিম বাবু পাপিয়ার বাড়িতে নিচে ভাড়া আসতে চান শুনে পাপিয়া রাজি হয়ে যায়। মহিম বাবু পরের মাসের গোরায় কিছু ফার্নিচার বেচে দিয়ে চলে এলেন এই নতুন ঠিকানায়। একা মানুষ, পাপিয়া ওদের ঝি আর রাঁধুনিকে লাগিয়ে দিল মহিম বাবুর বাড়ির কাজে।

দেখতে দেখতে আরও এক বছর চলে যায়। মহিম বাবু অফিস যান আর বাড়ি ফিরে সারা সন্ধ্যা ওঁর এলবাম খুলে স্ত্রী আর মেয়ের ছবি দেখে বা ওদের সাথে তোলা ভিডিও দেখে সময় কাটান। ওপরের ঘরে বসে পাপিয়া সবই বুঝতে পারে এবং ভদ্রলোকের জন্য মনে মনে খুব কষ্ট পায়। পল্লব আসে যায় বোনের জন্য বিয়ের সম্বন্ধ দেখে কিন্তু কিছুই আর এগোয় না। এখন নিজের ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিনে দিনে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ে পল্লব। এদিকে পাপিয়ার বয়স গিয়ে পৌঁছায় একচল্লিশে।

সেদিন রবিবার বেলার দিকে পল্লব ওর নিজের অংশে একজন ভাড়াটে বসাবার কথা ভেবে আসে ঘরগুলির কী কী কাজ করাতে হবে দেখতে। পাশের ভাড়াটে মহিম বাবু তখন ওপরে, তার ঘরে তালা মারা। পল্লব চাবি দিয়ে নিজের অংসের ঘর খুলে সব দেখে ওপরে যায়। হটাত বোনের কান্নার আওয়াজে চমকে ওঠে পল্লব। দোতলায় সামনের গ্রিলের গেট খোলাই ছিল। পল্লব ভিতরে পা রেখে বসবার ঘরে উঁকি মেরে দেখে নিচের ভাড়াটে মহিম বাবু একটা সোফায় বসে নিঃশব্দে কাঁদছেন, আরেকটা সোফায় বসে পাপিয়া হাউ হাউ করে কাঁদছে। পল্লব আগে থেকেই জানত যে এই ভদ্রলোক তার স্ত্রী ও মেয়েকে হৃষীকেশের গঙ্গায় হারিয়ে এসেছেন। বেচারা এখন বোনের নিচের ঘরে এক থাকেন।

পল্লব যেটা জানতো না সেটা হল ওর বোন পাপিয়া ইতিমধ্যে মহিম বাবুকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবাসা তো আর বয়স বা সময় দেখে হয় না। একসাথে থাকতে থাকতে দুজন দুজনকে দেখতে দেখতে বা দুজনের দুঃখ দুঃখিত হয়েও মানুষের মনে ভালোবাসার জন্ম হয়। পাপিয়ার নিজেরও একটা মন আছে। ওর কাছে এখন নিজের দুঃখ আর মহিম বাবুর দুঃখ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আর আজ মহিম বাবু ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিতেই পাপিয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে। পল্লব ঘরে ঢুকতেই সব বুঝে যায়। পাপিয়া দাদাকে দেখেই উঠে এসে পল্লবের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতেই বলে,’ উনি আমাকে বিয়ে করতে চান দাদা। বল এখন আমি কী করব ?’

পল্লব মহিম বাবু বোনের দায়িত্ব নিয়ে পাপিয়াকে বিয়ে করতে চায় শুনে ভীষণ খুশি হল। দেখে মহিম বাবু উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। পল্লব হাসি মুখে বোনের মাথায় হাত রেখে বলে,’ আরে পাগলী, সেতো খুব ভালো কথা। দাড়া, আমি তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করছি। মহিম তোকে নিয়ে খুব সুখী হবেরে পাপিয়া। কাঁদিস না। আমি তোদের দুজনকে আশীর্বাদ করছি।‘

মহিম বাবু এগিয়ে এসে পল্লবের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করল। দেখা দেখি পাপিয়াও ছলছল চোখে দাদাকে প্রণাম করে মহিম বাবুর দিকে তাকিয়ে লজ্জায় চোখ নামায়। 

                  ——–শেষ———