ফেস বুক স্ট্যাটাস        – উত্তম চক্রবর্তী।

নির্মল চৌধুরীর একটাই বদ অভ্যাস। আর সেটা হল কোথায় বেড়াতে যাচ্ছে, কোন হোটেলে খেতে যাচ্ছে, কোন এয়ারপোর্টে চেক ইন করলেন আর কোন শপিং মলে কেনাকাটা করতে ঢুকলেন সমস্ত কিছু সন্ধ্যাবেলায় তুলসী তলায় প্রদীপ দেখানোর মত ফেস বুকের পাতায় ( মানে ফেস বুকে তার প্রোফাইলে ) উনি আপডেট করবেনই। নির্মল বাবুর ব্যাঙ্কের সহকর্মীরা অনেকেই বারণ করেছে ‘এরকম স্ট্যাটাস দেওয়া ঠিক নয়। কী দরকার সবাইকে তোর ব্যক্তিগত জীবনের সব কিছু জানাবার। কখন কী বিপদ ঘনিয়ে আসে কেউ কি বলতে পারে ?

কিন্তু ত্যাড়া বিড়ালের মত সবজান্তা নির্মল চৌধুরী কারো কথাই কোনদিন শোনেন নি। পরদিন কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, ’কিরে, কাল তো দেখলাম অমুক রেস্টুরেন্টে খেতে গেছিস, তা কেমন খেলি কাল,’ বা হয়ত কেউ জিজ্ঞাসা করল, ’কী খবর, কাল খুব মার্কেটিং করলেন !’ নির্মল বাবু সেগুলি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন। গর্বে যেন ওঁর বুকটা ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ফুলে ওঠে। ওদের একমাত্র মেয়ে জুঁই বাবার এসব আদিখ্যেতা একদম পছন্দ করেনা। ফেস বুক দেখা আর তাতে নিজের ব্যক্তিগত সব কিছু পাবলিক করে দেওয়া আজকাল অনেকেই পছন্দ করে না। সবাই ফেস বুক চেক করে রোজ, কিন্তু কোন কমেন্ট করা বা স্ট্যাটাস আপডেট করা জুঁইয়ের মত অনেকেই পছন্দ করেনা।

নির্মল বাবু দুর্গা পূজোর পর এবার সপরিবারে রওনা দিলেন শালীর বাড়ি মুম্বাইয়ের উদ্দেশে। সকাল দশটার ফ্লাইট। দমদম এয়ারপোর্টে চেক ইন করেই নির্মল চৌধুরী যথাযথ স্ত্রী জয়াকে পাশে রেখে সেলফি তুলে ফেস বুকে পোস্ট করে দিলেন ‘চেকড ইন এট কলকাতা এয়ারপোর্ট ফর এ হলিডে ট্রিপ টু মুম্বাই।‘ এদিকে ওঁর মেয়ে জুঁই তার বয় ফ্রেন্ডকে বম্বে বেড়াতে যাবার ব্যাপারে কিছুই জানায় নি। ভেবেছিল চুপচাপ বাবা মার সাথে বম্বে মাসীর বাড়িতে গিয়ে মাসতুতো ভাই বোনদের সাথে কয়েকদিন হৈ হুল্লোড় করে কাটিয়ে দেবে। কিন্তু ঐ যে বলে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ব্যস, নির্মল বাবুর ফেস বুক পোস্ট দেখেই জুঁইয়ের বয় ফ্রেন্ড রোহিত ক্ষেপে গিয়ে জুঁইকে ফোন লাগাল।

কিন্তু জুঁই তখন ফ্লাইটে বসে, ফোন ফ্লাইট মোডে করা। রোহিত সেই বেলেঘাটা থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে সোজা পৌঁছে যায় মানিকতলায় জুঁইদের ফ্ল্যাটে। তালা মারা দেখে পাশের ফ্ল্যাটের দরজায় বেল দিতেই একজন বয়স্কা মহিলা দরজায় এসে জানালেন ওরা সবাই আজ সকালেই বেরিয়ে গেছে মুম্বাইতে ওর মাসীর বাড়িতে যাবে বলে সকাল দশটার ফ্লাইট ধরতে। রাগে গজগজ করতে করতে রোহিত বেরিয়ে আসে। রোহিতকে জুঁইয়ের বাবা নির্মল চৌধুরী একদম পছন্দ করেন না। ওর চেহারাটাই কেমন যেন বখাটে ছোকরাদের মত। লম্বা, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া অগোছালো চুল, মুখে চাপদাড়ি। সবসময়য় পরনে চাপা জিনস আর টি সার্ট, তাও রঙের কোন বালাই নেই।

রোহিত মধ্যবিত্ত ঘরের বখে যাওয়া ছেলে। অত্যন্ত নিচু মানের লোকদের সাথে মেলামেশা। ওরই এক বন্ধুর মাধ্যমে জুঁইয়ের সাথে আলাপ। জুঁইকে পটিয়ে ওকে নিয়ে সিনেমায় যাওয়া, গঙ্গায় নৌকা ভ্রমণ করা, লুকিয়ে আড়ালে চুমু টুমু খাওয়া বা ওর বুকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে আদর করা ইত্যাদি করে জুঁইকে বশ করে রেখেছে। রোহিত জানে জুঁই ওর বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে। মানিকতলার এতো সুন্দর ফ্ল্যাটখানা ভবিষ্যতে জুঁইয়েরই হবে। সুতরাং জুঁইকে হাতছাড়া করলে চলবে না। কিন্তু জুঁই এভাবে ওকে না জানিয়ে বম্বে বেড়াতে গেছে জেনেই রোহিতের মাথা গরম হয়ে গেছিল। রাস্তায় নেমেই রোহিত ফোন করল রাজাবাজারের আসলাম ভাইকে। কথা বলেই বুঝতে পাড়ল যে আসলাম ভাই ইতিমধ্যেই নির্মল বাবুর ফেস বুক পোস্ট দেখেছে। আজ রাতেই নাকি মানিকতলার ফ্ল্যাটে ওদের অপারেশন আছে।

নির্মল বাবুর ফ্ল্যাট যেই বিল্ডিঙে সেই বিল্ডিঙে দুই মাস আগেই আসলাম ও তার দল চুরি করে গেছে। তখনই লক্ষ্য করেছে নির্মল বাবুর কিচেনের জানালার পাল্লা বেশ নড়বরে। এর পরেই একদিন আসলাম গ্যাস কোম্পানির লোক সেজে এসে বাড়ির ভিতরটা চেক করে গেছে। বাড়িতে তখন শুধু জয়া ছিল। নির্মল বাবু অফিসে আর জুঁই ছিল কলেজে। আসলাম নির্মল বাবুর নাম ওর বাড়ির নেম প্লেটে দেখে ওঁকে ফেস বুকে খুঁজে পায় এবং ফলো করা শুরু করে। আসলামের কাজের এটা একটা বড় পদ্ধতি বা গোপন টেকনিক বলা চলে। শিকার করার আগে বাঘ যেমন লক্ষ্যকে নজরে রেখে তার হাবভাব চালচলন লক্ষ্য করতে থাকে, আসলামও ঠিক সেভাবে আটঘাট বেধেই কাজে নামে।

এদিকে রোহিতও আসলামের দুনম্বরী কাজের এক রকমের পার্টনার। সেই রাতেই নির্মল বাবু যখন বোম্বেতে শালীর বাড়িতে জমিয়ে আড্ডা মেরে খাওয়া দাওয়া করে মৌজ মস্তি করছেন তখনই কিচেনের জানালা দিয়ে আসলাম আর ওর সাগরেদ মুন্না গিয়ে ঢুকল জুঁইদের ফ্ল্যাটে। মাষ্টার কি দিয়ে স্টিলের আলমারি খুলে প্রায় হাজার পঞ্চাশ টাকা ক্যাশ, আড়াইশ গ্রাম সোনা, একটা ল্যাপটপ, একটা হাত ঘড়ি, দুটো পুরানো সেল ফোন ও দামী কিছু সিল্কের শাড়ী গুছিয়ে নিয়ে এক ঘণ্টা বাদেই চম্পট দেয় ওরা। রোহিত রাত আড়াইটায় খবর পেয়ে গেছিল যে অপারেশন সাকসেসফুল।

নির্মল বাবু বাড়ি ফিরেই মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। বম্বে বেড়াবার আনন্দ তখন শিকেয় উঠেছে। থানা পুলিশ করবার কথা তুলতেই জুঁই বলে উঠল,’ দাঁড়াও বাবা, আমি রোহিতকে ডাকছি। ওর অনেক চেনাজানা আছে। আগেই থানা পুলিশ করতে যেও না।‘

রোহিত এলো পর ঘুরে ঘুরে সব দেখে বলল,’ আপনাদের কিচেন দিয়ে চোর ঢুকেছিল। চিন্তা করবেন না আঙ্কল। আমি কয়েকজনকে চিনি। দুই দিনের মধ্যেই সবকিছু ফিরে পাবেন। তবে আপনার এই ফেস বুকে স্ট্যাটাস দেওয়া এবার বন্ধ করুন আঙ্কল। চোরেরা কিন্তু ওত পেতে বসে থাকে আজকাল।‘ নির্মল চৌধুরী আজ রোহিতের প্রতি খুশিতে ঝকমকিয়ে উঠলেন, আবার লজ্জা পেয়ে বললেন,’ মাথা খারাপ। ঘাট হয়েছে আমার। ফেস বুক দেখাই ছেড়ে দেব এবার।‘ মনে মনে ভাবলেন মেয়ে বেশ ভাল একটা বুদ্ধিমান ছেলেকেই পটিয়েছে। এবার ওদের বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে।

                                     ——–শেষ——–

* ফটো সৌজন্যে – গুগুল।