অস্ফুট ভালোবাসা    – উত্তম চক্রবর্তী।

ধিরেন মৈত্র তার ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছিলেন। অবশেষে ওঁর বাল্য বন্ধু বলাই মুখুজ্জের ছোট মেয়েকেই এক দেখায় পছন্দ করে ফেলেছিলেন। পঁচিশ বছরের লীনা সত্যিই সুন্দরী। বলাইয়ের সাথে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর বাদে দেখা।  একসাথে স্কুল ও কলেজ পাশ করে ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল। বলাই চাকরি নিয়ে চলে গেছিল জামশেদপুর আর ধিরেন কলকাতায় একটা বিদেশী ফার্মে ঢুকে যায়। তারপর এতো বছর বাদে এসপ্লানেডে দেখা। ওদের বেলুরের বাড়িতে গিয়ে সেদিন লীনাকে দেখেই ধিরেন বাবুর ভাবি পুত্র বধুকে পছন্দ হয়ে যায়। বন্ধুকে ছেলে অর্পণের সাথে মেয়ের বিয়ের কথা পেরে ফেলেন।

অর্পণ বি টেক করে একটা সফট ওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করছে আজ চার বছর হয়ে গেছে। ধিরেন বাবু অর্পণের বোন ওঁর একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বেহালার চ্যাটার্জি পরিবারে। তারপর থেকেই অর্পণের জন্য ভাল মেয়ে খুঁজছিলেন। অর্পণ আসলে ভীষণ লাজুক, মুখচোড়া টাইপের ছেলে। ধিরেন বাবু প্রায়ই ওঁর স্ত্রীকে একান্তে বলতেন, ‘গাধা ছেলে একটা। ওর বয়সে আমার কত গার্ল ফ্রেন্ড ছিল, কিন্তু এটা একটাকেও পটাতে পারল না। এতো মুখচোড়া ছেলের সাথে কে প্রেম করবে ? কী একটা ছেলে তোমার !’ ব্যস এই নিয়েই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি চলছিল। শেষে লীনাকে দেখেই পরের রবিবার স্ত্রী পুত্র সহ ধিরেন বাবু চলে গেলেন ওদের বেলুরের বাড়িতে, একদম কথা পাকা করে এলেন। মাঘ মাসের চার তারিখে বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল।

অর্পণ লীনাকে দেখেও না দেখার ভাণ করে বসেছিল প্রথমে। শেষে ওর মায়ের চাপে পড়ে মুখ তুলে দু বার তাকিয়েছিল শুধু লীনার দিকে। তার পরেই মাথা নাড়িয়ে ওর মত দেওয়ায় এই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিল। লীনার অর্পণের সুন্দর স্মার্ট চেহারা ভালো লেগেছিল, কিন্তু অবাক হয়ে গেছিল ওর এই লাজুক লাজুক ভাব দেখে। অর্পণের মা অবশ্য বারবার বলছিলেন যে ওঁর ছেলে ভীষণ মুখচোড়া স্বভাবের, আর মেয়ে দেখলে তো কথাই নেই। এম এস সি পাশ করা স্মার্ট আধুনিক মেয়ে লীনা মনে মনে ভাবে বিয়ের পর আমার প্রথম কাজই হবে ওকে গড়ে পিটে ঝক ঝকে করে তোলা।

অর্পণ বাসর রাতে মাসতুতো পিসতুতো বোনেদের আর খুড়তুতো বৌদিদের চাপে পড়ে শেষে রাত একটা নাগাদ ওর ঘরে ঢুকে দরজা আটকায়। ফুল দিয়ে সাজানো খাটে হাঁটু মুড়ে বসে আছে লীনা। লীনা মুখ তুলে দেখে অর্পণ সেই দরজার দিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকাচ্ছেও না। শুভ দৃষ্টির সময়েও ও কিছুতেই মুখ তুলছিল না। যেন অর্পণ হল পাত্রী আর লীনা হল পাত্র। এই নিয়ে ওদের বাড়িতে বিয়ের মণ্ডপে সবাই কি হাসাহাসি করছিল। লীনার ভীষণ লজ্জা লাগছিল তখন। কিন্তু এখন ওর বাসর রাতে নতুন জামাই ওর সামনেই এতো লজ্জা পাবে লীনা ভাবে নি।

লীনা বুঝল এবার যা করবার ওকেই করতে হবে। খাট থেকে নেমে সোজা এসে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো দরজার সামনে। অর্পণের একদম সামনে দাঁড়িয়ে দেখে অর্পণ তখনো মুখ নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে। লীনার ওর অবস্থা দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে তখন। নব বধু সাজে সজ্জিতা লীনা ওর নতুন বরকে দেখতে স্বামীর মুখ তুলে ধরে আর ফিস ফিস করে বলে, ‘কী হল, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি ? আমি কখন থেকে একা বসে আছি।’ লীনা অর্পণের একহাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে যায় বিছানায়। বাধ্য ছেলের মত অর্পণ লীনার কাছে সপে দেয় নিজেকে। একটা ইওং হ্যান্ড সাম ছেলে কী ভাবে এতো লাজুক হয় লীনা ভাবতেও পারছিল না। অর্পণকে বিছানায় ফেলে লীনাই ওকে আদর করতে শুরু করে দেয়। অর্পণ কিন্তু তেমন সাড়া শব্দ দেয় না। লীনা ভাবে, ঠিক আছে, আজ প্রথম দিন। হয়ত ওকে বাগে আনতে আরও টাইম লাগবে। সেই টাইম লাগতে লাগতেই প্রায় একমাস কেটে গেল ওদের বিবাহিত জীবনের।

অর্পণ অফিস থেকে আজকাল বাড়ি ফেরে তাড়াতাড়ি। ধিরেন বাবু আর তার স্ত্রী বুঝলেন যে ছেলের মধ্যে সুন্দরী বৌয়ের প্রতি টান বাড়ছে। আসলে লীনাই অর্পণকে বলে দিয়েছে যে অফিস থেকে যেন সোজা বাড়িতে চলে আসে। অর্পণ যতই লাজুক হোক ওর লীনাকে বেশ ভালো লাগে। ওর শরীরের মিষ্টি মেয়েলি গন্ধে অর্পণ ধীরে ধীরে নেশাখোর মাতালের মত হয়ে ওঠে। ভালুক যেমন মহুয়ার গন্ধে মাতাল হয় অর্পণও তেমন লীনার শরীরের গন্ধের নেশায় পড়ে যায়। রাতে শুধু অপেক্ষা করে কখন লীনা লাইট নিভিয়ে ওর পাশে এসে শোবে। অর্পণের আলো জ্বালিয়ে শুতে খুব লজ্জা করে।

এরই মাঝে ওরা একদিন এসপ্ল্যানেড গেল কিছু শপিং করতে। লীনা দারুণ সুন্দর ম্যাচিং করা নীল সিল্কের শাড়ি ব্লাউজে সেজে অর্পণের সাথে গগলস চোখে পরে বেরিয়েছিল। নিউ মার্কেটে লীনার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল কিছু যুবক। অর্পণের ভীষণ রাগ হতে থাকে। ভাবে ওরা কেন ওর বৌকে এতো ঘুরে ঘুরে দেখবে ? সুন্দরী মেয়েকে দেখেনি কোন দিন ? লীনা লক্ষ্য করছিল অর্পণের হাবভাব ও মুখভঙ্গি। ও বেশ বুঝতে পারে অর্পণ চায়না ওর বৌকে নিয়ে কেউ আদিখ্যেতা দেখাক। লীনা মনে মনে হাসে। আরে আমি সুন্দর, লোকে আমাকে দেখবে না ! এতো পসেসিভ কেন অর্পণ ? তবুও লীনার ভালো লাগে অর্পণের এই গভীর ভালোবাসা যার কোন বাহ্যিক প্রকাশ অর্পণ কোনদিনই করে না।

সেই ঘটনার পর আরেকদিন ওরা গেছিল মেট্রো মলে একটা হিট হিন্দি সিনেমা দেখতে। সেখানে লীনার পাশে বসেছিল একজন যুবক ও তার ওপাশে ওর গার্ল ফ্রেন্ড। অর্পণের পাশে বসেছিল একজন বয়স্কা মহিলা ও তার ওপাশে ওঁর স্বামী। সিনেমা শুরু হবার আগেই লীনা লক্ষ্য করল পাশের ছেলেটা তার গার্ল ফ্রেন্ডকে চুমু খাওয়া বা গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে শুরু করে দিয়েছে। লীনা মনে মনে হাসছিল এই ভেবে যে অর্পণ বোধ হয় জীবনেও সিনেমা হলে ওকে চুমু খাওয়া তো দুরের কথা গায়ে একটু টাচও হতে দেবেনা। কেবল লোকের সামনে বৌয়ের থেকে দুরে দুরে থাকে।

অর্পণ বুঝতে পাড়ছিল লীনা ওর পাশের ছেলেটার কাণ্ড কারখানা দেখে হয়ত লজ্জা পাচ্ছে। ভালো করে সিনেমা দেখতে পাড়ছিল না বেচারা। অর্পণ আড় চোখে লীনার পাশে বসা ছেলেটার দিকে লক্ষ্য রাখতে থাকে। লীনা দেখতে পেয়ে দু তিন বার অর্পণের মাথা ঘুরিয়ে ফিস ফিস করে বলে, ‘কেন দেখছ ওদের ? ওরা যা খুশী করুক তুমি সিনেমা দেখো তো।’ কিন্তু অর্পণ হাফ টাইমের পরেই জায়গা বদল করে লীনাকে ওর পাশের সেই মহিলার দিকে সরে বসতে বলে নিজে ওদিকের ছেলেটার পাশে গিয়ে বসল। লীনা অর্পণের কাণ্ড দেখে মনে মনে খুব একচোট হেসে নেয়।  

বাড়ি ফিরে রাতে বিছানায় অর্পণের বুকের ওপর ঝাপিয়ে পরে লীনা। ওকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বলে, ‘তুমি এতো ভালো কেন গো ? আমি তো আছিই তোমার পাশে। তবুও তুমি আমাকে নিয়ে কেন এতো ভাব সব সময় ? আমি কি হারিয়ে যাব নাকি দুরে কোথাও চলে যাব যে তুমি সব সময় আমাকে আগলে আগলে রাখ ?’     

আজ এই প্রথম ওর শামুকের খোলস ছেড়ে নিজেকে ওর সুন্দরী স্ত্রীর সামনে খুলে ধরল অর্পণ। বৌকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল,’আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি লীনা। তুমি শুধু আমার, আর কারো নয়।’    

                ———শেষ———

* ফটো – গুগুল।