প্রেম যখন গভীরে –      – উত্তম চক্রবর্তী।

আজ আলিপুর ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসের সামনে বাঁ  দিকের মেডিক্যাল সপের পাশে ঠিক বেলা এগারোটায় দাঁড়াতে বলেছে ওকে প্রিয়ার ভালোবাসার মানুষটা। ময়ূখ ওর প্রিয় বন্ধু সমীর আর তার স্ত্রী মালাকে নিয়ে ঠিক সময়ে এসে পড়বে কথা দিয়েছে। আজ ওরা দুজন ওদের বন্ধুদের নিয়ে গিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে বিয়ের জন্য নোটিশ দিয়ে একসাথে লাঞ্চ করে যে যার বাড়ি ফিরবার কথা। অনুষ্ঠান করে বিয়ে না হলেও, বিয়ে বলে কথা। প্রিয়া বেশ একটু সেজে গুজেই এসেছে আজ।

প্রিয়ার বয়স এখন সাতাশ চলছে। এম এস শি ফার্স্ট ক্লাসে পাশ করে চাকরির চেষ্টা করছে প্রিয়া। উদ্দেশ্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো। ওর বাবা মোহন সাহার বড়বাজারে কাপরের ব্যবসা। প্রিয়ার দাদা আর বাবা মিলে সেটা চালায়। প্রিয়ার  জামাই বাবু রেলে চাকরি করেন। নিজেদের ফ্ল্যাট আছে বেহালাতে। প্রিয়ার চেহারা কিন্তু খুবই সুন্দর ও আকর্ষণীয়। গায়ের রং ফর্সা, স্বাস্থ্য বেশ ভালো, লম্বায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট, মাথায় লম্বা ঘন কালো চুলের ঢল নেমে গেছে এবং ওর মুখটাও খুবই সুন্দর। প্রিয়ার ইচ্ছা ওর বান্ধবীর মত স্কুল টিচার হওয়া। প্রিয়া জানত ওর ব্যাক্তিত্বর সাথে টিচারির চাকরিই মানাবে।  

ময়ূখ বেহালাতে প্রিয়ার বড় জামাই বাবুর পাড়াতে ভাড়া থাকে। দিদির বিয়ের সময়েই আলাপ আর তারপর ধীরে ধীরে ওদের সম্পর্ক গভীর প্রেমে পরিণত হয়েছে। ময়ূখ একটা সাধারণ  চাকরি করে। ওর বাড়িতে শুধু মা, বাবা আর একটা ছোট কলেজে পড়া বোন আছে। প্রিয়ার দিদি জামাইবাবু সবই জানে, কিন্তু ওদের কোনদিন বাঁধা দেয়নি। বরং ময়ূখের মত ভাল সুন্দর ও ভদ্র ছেলের সাথে প্রিয়ার সম্পর্ক হওয়ায় ওরা দুজনেই খুব খুশী হয়েছিল। যদিও প্রিয়ার বাবা মারা প্রিয়া আর ময়ূখের এই সম্পর্কের ব্যাপারে এখনো কিছুই জানেন না। প্রিয়ার প্ল্যান হচ্ছে ওদের রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে দিদি জামাইবাবুর সামনেই একদিন বাবা মাকে সব জানাবে। তারপর মা বাবা আর ফেলতে পারবে না।

বেলা সাড়ে বারোটা বেজে গেল কিন্তু না এলো ময়ূখ আর না এলো ওর বন্ধু সমীর তার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে। যতই বেলা বাড়তে থাকে ততই সূর্যের তাপের চেয়েও বেশী প্রিয়ার মনের উদ্বেগ বাড়তে থাকে। এদিকে ময়ূখের বা সমীরের দুজনেরই ফোন সুইচ অফ শোনাচ্ছে। মনের কোণে অনেক রকম দুশ্চিন্তা ও কু চিন্তা ভিড় করতে শুরু করে দেয়। অবশেষে প্রিয়া অনেক বার দুজনকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করেও ওদের কাউকেই না পেয়ে বেলা আড়াইটা নাগাদ বাড়ি ফিরে গেল হতাশ ও ভগ্ন মন নিয়ে। ময়ূখ কেন এলো না বা কেন ওর ফোন সুইচ অফ করে রেখেছে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ল প্রিয়া। ময়ূখ ওকে ধোঁকা দেবার মত ছেলে তো না। তাহলে কেন ও আজ প্রিয়াকে এখানে এসে দাঁড়াতে বলেছিল ? ওর ফোনই বা কেন এখন বন্ধ করে রেখেছে ?  

প্রিয়া পাগলের মত ময়ূখের সাথে দেখা করবার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ময়ূখের কোন খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিয়া সেদিন রেজিস্ট্রির নোটিশ জমা দেবে সেটাও দিদিকে জানায় নি। বাধ্য হয়েই প্রিয়া দিদির বাড়ি গেল ময়ূখের খোঁজ নিতে। কিন্তু গিয়ে শুনল ময়ূখরা নাকি ঐ পাড়া ছেড়ে কোথাও চলে গেছে ঠিক দু দিন আগে। ওদের কোন খোঁজ দিদি বা জামাইবাবু কেউই দিতে পারলনা। প্রিয়ার জীবন থেকে ময়ূখ যেন হঠাৎই হারিয়ে গেল। এখন ফোন করলে শোনা যায় ‘দিস নাম্বার ডাস নট এক্সিস্ট।’ প্রিয়া লক্ষ্য করল ময়ূখ ফেস বুকের বা ইন্সটাগ্রামের একাউন্টও বন্ধ করে দিয়েছে। 

ভীষণ ভাবে ভেঙ্গে পড়লেও প্রিয়া হাল ছাড়বার মেয়ে নয়। জীবনের লক্ষ্যে ওকে পৌঁছতেই হবে। নদী যেমন বাঁধা পেলেও তার চলার পথের মুখ ঘুড়িয়ে সামনের দিকে বয়ে চলে, সেরকমই প্রেমে ধোঁকা খেলেও প্রিয়ার এই জীবন তো আর থেমে থাকবে না। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে একদিন প্রিয়া একটা সরকারি স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে গেল পুরুলিয়া। ওখানে আগে দাদার সাথে গিয়ে একটা হোস্টেলে থাকবার ব্যাবস্থাও করে নেয়। মনে মনে ঠিক করে আর কোন ছেলের দিকে তাকাবেও না প্রিয়া।  ও সাড়া জীবন বিয়েই করবে না আর। বাবা মা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেন আর ওকে বিয়ে দেবার জন্য ভাল ভাল সম্বন্ধ এনে দেয় সবাই। কিন্তু প্রিয়া ওর সিদ্ধান্তে অনড় হয়ে চলে যায় কলকাতা থেকে অনেক দুরে পুরুলিয়ায়। প্রিয়া কিছুতেই ওর মনকে শান্ত করতে পারেনা।

দুই বছর বাদে প্রিয়া সেবার গরমের ছুটিতে কলকাতায় এলো বেশ কয়েকদিন বাড়িতে থাকবার জন্য। একা একা থেকে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আর স্কুলের কাজের মধ্যে থেকে প্রিয়া এখন ময়ূখকে অনেকটাই ভুলতে পেড়েছে। দাদারও বিয়ে হয়ে গেছে। নতুন বৌয়ের সাথে প্রিয়ার খুব ভাব হয়ে গেছে। বৌদি সোনালি ভীষণ মাই ডিয়ার আর প্রিয়ার বন্ধুর মত হয়ে গেছে। প্রিয়া আর সোনালি দুজন বেরিয়ে শপিং করে, একসাথে সিনেমা দেখতে যায় বা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খেয়ে বাড়ির জন্যও নিয়ে আসে। এসব করতে করতেই প্রায় পনের দিন কেটে গেল। বাড়িতেও ওকে না জনিয়েই ওর জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। ময়ূখের কোন খোঁজ আজও পায়নি প্রিয়া। সমীরদাও বোধ হয় তার ফোন নম্বর পাল্টে ফেলেছে। প্রিয়া ধরেই নিয়েছে যে ময়ূখ নিশ্চয়ই এতো দিনে অন্য  কাউকে বিয়ে করে ফেলেছে।

সোনালি সেদিন অন লাইনে ডিনারের জন্য খাবার বুক করেছিল। দরজায় কলিং বেল শুনে প্রিয়া দরজা খুলেই চমকে উঠল। দরজার বাইরের হাল্কা আলোতে প্রিয়া পরিষ্কার দেখতে পেলো মাথায় হেলমেট পরে সামনে দাঁড়িয়ে আর কেউ না, স্বয়ং ওর ময়ূখ। হাতে ওদের অর্ডার দেওয়া খাবারের প্যাকেট । ময়ূখ প্রিয়াকে দেখেও না চিনতে পারার অভিনয় করে প্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে দিয়েই চলে যায়। দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে কেমন যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। প্রিয়ার সন্দেহ হয়। তাড়াতাড়ি বৌদিকে ডেকে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে প্রিয়াও  ওর পিছন পিছন নিচে নেমে আসে। ময়ূখ এই এতদিন বাদে ওকে দেখেও কেন এইভাবে, তাও আবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে নেমে চলে গেল ? এমন একটা ভাব দেখাল যেন ওকে চেনেই না ! 

ওদের ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে লাল রঙের একটা বাইক দাঁড়ানো ছিল। প্রিয়া দেখে ব্যাগ কাঁধে ময়ূখ সেই বাইকে উঠবার চেষ্টা করছে। প্রিয়া চমকে উঠল যখন ও রাস্তার আলোয় দেখল ময়ূখের ডান পায়ের প্যান্টের নিচ দিয়ে ওর লোহার ফ্রেমে লাগানো কাঠের পাটা বেরিয়ে এসেছে। তার মানে ময়ূখ নিশ্চয়ই দুর্ঘটনায় ওর একটা পা হারিয়েছে ! প্রিয়ার বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে ওঠে। ময়ূখ কিন্তু তখনো দেখেনি যে পিছন থেকে প্রিয়া এসে ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে। ময়ূখ গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দেবার আগেই প্রিয়া এসে ওর হাত ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে দেয়। ময়ূখ প্রিয়াকে দেখে বলে ওঠে, ‘কি করছেন কি ম্যাডাম। হাত ছাড়ুন ।’

প্রিয়া ময়ূখের খুঁড়িয়ে হাঁটা আর তারপর ওর ডান পায়ে লোহার ফ্রেমে লাগানো কাঠের পা দেখেই বাকি গল্পটা বুঝে ফেলেছিল। কান্না ভেজা গলায় বলে ওঠে, ‘তোমার সেদিন বাইক এক্সিডেন্ট হয়েছিল তুমি সেটা আমাকে জানাবার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করনি ময়ূখ ? এই তোমার ভালোবাসা ? এরকম কোন এক্সিডেন্ট করে আমি যদি কোনদিন পঙ্গু হয়ে যেতাম তুমি কি পারতে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে ? জানো আমি তোমাকে কত খুঁজেছি ময়ূখ ? কেন তুমি এমন করলে আমার সাথে ? কেন তুমি সেদিন আসনি  আমাকে সেটা ফোন করে জানাতে কী হয়েছিল তোমার ? তুমি দেখতে আমি কী করতাম তখন। আমাকে তোমার জীবন থেকে একেবারে বাদই দিয়ে দিলে ?’

ময়ূখ বাইকে বসেই উত্তর দেয়, ‘আমি তোমার জীবনে একটা অভিশাপ হয়ে থাকতে চাইনি প্রিয়া। আজ আমি একটা পঙ্গু লোক। পারবে তুমি এই পঙ্গু মানুষটাকে বিয়ে করতে প্রিয়া ? আমার আগের চাকরিটাও চলে গেছে। আমি যে এখন একটা সামান্য ডেলিভারি বয় মাত্র। আমার আর কোন ভবিষ্যৎ নেই প্রিয়া। আমাকে তুমি ভুলে যাও। অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হয় তুমি । বলতে গিয়ে ময়ূখের গলা বুজে আসে।

প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয়,  ‘আমি তোমাকে ভালবেসেছি, তার পা কে না। তুমি এখনো আমার কাছে সেই আছো যা আজ থেকে দুই বছর আগে ছিলে। আমি তোমাকেই বিয়ে করে সংসার করতে চাই ময়ূখ। আজ আর আমাকে ফিরিয়ে দিও না প্লিস। এবার তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি কিন্তু আত্মহত্যা করব ময়ূখ।’ প্রিয়া ওখানে দাঁড়িয়েই হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার জলের মত ওর দুই গাল বেয়ে নামতে থাকে তপ্ত জলের ধারা।

ঠিক তখনই পিছন থেকে প্রিয়ার বৌদি সোনালির গলা শোনা গেল। সোনালি বলে উঠল, ‘তোমরা ঘরে এসো প্রিয়া। আমি নিজে তোমার দাদা আর বাবাকে সব বুঝিয়ে বলে তোমাদের বিয়ে দেব। এসো ভাই, তোমার ব্যাপারে আমি দিদির কাছে সব শুনেছি। এই তোমার জন্যই কিন্তু আমার ননদ আজও বিয়ে করেনি ভাই। কলকাতা ছেড়ে সেই কতদূরে পুরুলিয়াতে গিয়ে একা একা থাকে, স্কুলের টিচারির চাকরি করছে। তোমাকে আজ আমরা ছাড়ছি না ময়ূখ ।’

ময়ূখ লজ্জায় মাথা নিচু করে বাইক থেকে নেমে আসে। ভেবেছিল প্রিয়াকে আজ সত্যি কথা বলে ওর জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা একটা সুতোর মতো ক্ষিন সম্পর্কটা চিরদিনের মত ছিঁড়ে ফেলবে। কিন্তু ময়ূখ তো আর জানে না যে এই সুতো অনেক বেশি শক্ত আর মজবুত, স্বয়ং ভগবান বেঁধে দিয়েছেন উপরে বসে। মানুষ কিছুদিনের জন্য কাউকে ভুলে থাকতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসাকে কেউ কোনদিন ভুলতে পারে না।

সোনালি ওর বড় ননদের কাছে আগেই প্রিয়ার ব্যাপারে সব শুনেছিল মেয়েটার জন্য ওর খুবই কষ্ট হত। তবে প্রিয়ার মতই কেন ওকে ছেড়ে দিয়ে ময়ূখ চলে গেছিল ওর জীবন থেকে সেটা জানতো না সোনালি। তবে আজ ওকে সচক্ষে দেখে আর পিছনে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনেই বুঝতে পেড়ে গেছিল যে এরা দুজন দুজনকে কতোটা ভালোবাসে। এই সত্যিকারের ভালোবাসাকে সোনালি যে ভাবেই হোক বাঁচিয়ে রাখবে, ওদের দুই হাত এক করতে যা করবার করবে সোনালি। প্রিয়া ময়ূখকে ধরে ধরে আবার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে নিয়ে যায়। সোনালি আগে আগে গিয়ে শাশুড়িকে খবর দিয়ে বলল, ‘মা, দেখুন আমাদের জামাই আসছে মা ।’

প্রিয়ার মা বাবা দুজনেই তাদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। প্রিয়ার মা আগেই বড় মেয়ের কাছ থেকে ভাসা ভাসা কিছুটা জানলেও বাবা কিছুই জানতেন না। কিন্তু মোহন বাবুর নিজের ছোট মেয়ের উপর যথেষ্ট ভরসা আছে।  তার আদরের মেয়ে কোনদিন কোন ভুল করবে না তিনি জানতেন। সোনালি “জামাই” আসছে বলতেই বাকি গল্পটা বুঝে নিয়ে গিন্নির দিকে তাকিয়ে প্রথমেই বললেন, ‘কি গো, দাঁড়িয়ে দেখছ কী, যাও গিয়ে শঙ্খ নিয়ে এসো, প্রদীপ ধরিয়ে নিয়ে এসো। আমার মা তার জীবন সঙ্গীকে নিয়ে ঢুকছে। বৌমা তোমরা উলু দাও।’

ময়ূখের চোখে জল চলে এলো। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে মাথা নিচু করে দুজনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেছিল, কিন্তু প্রিয়ার বাবা ওকে ধরে বুকে টেনে নিলেন। সোনালি জড়িয়ে ধরল ওর ননদকে।   

                ——-শেষ——-  

* ছবি সৌজন্যে – গুগুল।