ll কাটা হাতের খোঁজে ll   (ভূতের গল্প)         – উত্তম চক্রবর্তী। 

১২৩১১ হাওড়া কালকা নেতাজি এক্সপ্রেসে এ সি ফার্স্ট ক্লাসের এ ৮ নম্বর কুপে ওর সিট পড়েছে আজ রাতে। অর্পণ প্রায়ই এই ট্রেনে আলীগড় যায় ব্যবসার কাজে। কলকাতায় ওদের বিকলাঙ্গদের জন্য তৈরি কাঠের হাত, পা ইত্যাদির একটা বিশাল বড় শোরুম আছে কলাকার স্ট্রীটে। পৈতৃক ব্যবসা, দুই ভাই মিলে বাবার সাথে কাজ করে। অর্পণ বাইরে মাল কেনা বেচার দিকটা দেখে। প্রায়ই ওকে আলীগড়ের ফ্যাক্টরিতে  গিয়ে মালপত্র দেখে অর্ডার দিতে যেতে হয়। কাল বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আলীগড় পৌঁছে যাবে ট্রেন। অর্পণ সেখানে দুদিন থেকে ফিরবে।

এ সি ফার্স্ট ক্লাসের এই কুপে শুধুমাত্র অর্পণই একজন যাত্রী। হাওড়া থেকে ঠিক সাতটা চল্লিশেই ট্রেনটা ছেড়েছে।  ট্রেনে বসেই ওর স্ত্রী মীনাক্ষীর দেওয়া টিফিন কৌটো খুলে ডিনারে রুটি মাংস খেয়ে রাত নটা নাগাদ শুয়ে পড়ল অর্পণ। টিকিট চেকিং হয়ে গেছে। একটা অদ্ভুত হাসি হেসে টি টি ই জানালেন রাত তিনটের সময় গয়া থেকে নাকি একজন প্যাসেঞ্জার উঠবে এই কুপে। সুতরাং গয়া অবধি আর কেউ ডিস্টার্ব করবে না। কম্বলে পা পর্যন্ত ঢেকে ওর নিচের বার্থে শুয়ে পড়ল অর্পণ।

গভীর ঘুমটা হটাত ভেঙ্গে গেল অর্পণের। ট্রেন তখন প্রায় একশ দশ কুড়ি কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। শুধু কূপের ভিতরে একটু নীল আলো জ্বলছে, পর্দা সরিয়ে অর্পণ দেখল বাইরে ঘুটঘুট্টী অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অর্পণ হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত একটা পঁচিশ বাজে। হটাত অর্পণ খেয়াল করে দেখে উল্টো দিকের বার্থের নিচ থেকে একটা ছায়া মূর্তি উঠে দাঁড়ালো যেন। মনে হল লোকটার পরনে একটা সাদা ধূতি আর সাদা ফতুয়া, ডান হাতটা নেই। লোকটা আবার নিচু হয়ে বা হাত দিয়ে ওর বার্থের নিচটা সমানে হাতড়ে হাতড়ে কিছু একটা জিনিষ বের করবার চেষ্টা করছে।

অর্পনের মনে পড়ল ও ঘুমোবার আগে কুপের দরজা দিয়েই শুয়েছিল। তাহলে এই লোকটা ভিতরে ঢুকল কিভাবে ? অর্পণ সময় হিসাব করে ভাবল একটু আগেই কোডাড়মা স্টেশন পাস করেছে। লোকটা হয়ত সেখান থেকেই উঠেছে আর টি টি ই দরজা খুলে দিয়েছে কোনভাবে। অর্পণ হটাত লোকটাকে দেখে ঘাবড়ে গেছিল ঠিকই, এবার ওকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি কিছু খুঁজছেন ?’

লোকটা তাকাল অর্পণের দিকে। ফ্যাস ফ্যাসে গলায় জবাব দিল, ‘আচ্ছা, আপনি কি কোন হাত দেখেছেন এই কুপে ? এই দেখুন আমার এই ডান হাতখানা ওই গুণ্ডা ডাকাতগুলি সেই রাতে এই কুপের ভিতরেই কেটে ফেলেছিল আর তারপর ট্রেন থেকে ঢাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। আপনি কি সেই হাতটা দেখেছেন ?’

লোকটার কথা শুনে অর্ণবের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ভাল করে তাকিয়ে লক্ষ্য করল লোকটা ট্রেনের মেঝে থেকে অন্তত এক ফূট উঁচুতে ভাসছে। আর সারা কুপে একটা কেমন পচা গন্ধে ভরে গেছে। অর্পণ একশ ভাগ নিশ্চিত এটা একটা অশরীরী আত্মা। লোকটাকে হয়ত এই কূপেই কেউ ওর ডান হাত কেটে ফেলে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছিল । লোকটা ভূত হয়ে রোজ হাত খুঁজতে ওঠে এই ট্রেনে।

অর্পণ ভয় পাবার ছেলে নয়। মনটাকে শক্ত করে বলল, ‘না , আমি তো কোন হাত দেখিনি ! তবে আমি আপনাকে একটা কাঠের হাত দিতে পারি। আমি এই ব্যবসাই করি। আমার কাছে দুটো হাত আছে আমার ব্যাগে। আপনি একটু বসুন।’ অর্পণ উঠে বসে সিটের নিচে রাখা ওর বড় ব্যাগটা খুলে পাল্টাবার জন্য রাখা একটা কাঠের ডান হাত তুলে দিল লোকটার হাতে। লোকটা শুধু বলল, ‘আপনি খুব ভালো মানুষ। জীবনে অনেক উন্নতি করবেন।’ লোকটা এই কথাটা বলতেই অর্পণ হঠাৎ দেখল লোকটাও কথায় যেন উধাও হয়ে গেল আর পচা গন্ধটাও চলে গেছে। অর্পণের বুক থেকে যেন একটা জগদ্দল পাথর নেমে গেল।

                               ——–শেষ——–

* ফটো সৌজন্যে – গূগূল।