ll খুল যা সিমসিম ll               – উত্তম চক্রবর্তী।

যশের আগে থেকেই জানা ছিল যে ঠাকুরদা বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন ছোট ছেলে হিসেবে। বড় জ্যাঠা আর পিসিও বাবাকে ভালোবাসতেন, কিন্তু দিনে দিনে সেই ভালবাসাটা অনেকটা পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে আসা নদির ধারার মত ফিকে আর শান্ত হয়ে এসেছিল। তার উপর বাবা যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সাহেবদের কোম্পানিতে চাকরী পেয়ে গেছিল তখন থেকেই সেই ভালোবাসার সম্পর্কে ঢুকে গেছে ঈর্ষা আর হিংসার পাঁচফোঁড়ন। জ্যাঠার শাড়ী কাপড়ের দোকান থেকে যা আয় হয় তাতে কোন মতে ছেলে শীর্ষকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন, আর একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছেন। সেখানে যশের বাবার রোজগার অনেক বেশি এবং সাহেব কোম্পানির দৌলতে লাফ স্টাইল একদম অন্যরকম ছিল। প্রায়ই  ইউরোপ আমেরিকায় যাওয়াটা যেন জলভাত হয়ে গেছিল ওঁর। একবার বাবা জার্মানি থেকে মাকে একটা বিদেশী হারমোনিয়াম এন দিলেন কারণ যশের মা খুব ভালো গান গাইতে পাড়েন।

ঠাকুমা আবার বড় জ্যাঠাকে খুব ভালবাসতেন প্রথম সন্তান হিসেবে। এদিকে ঠাকুরদা বাবার বুদ্ধিমত্তা, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পড়াশুনায় বরাবর ভাল রেসাল্ট করবার জন্য বাবাকেই বেশি ভালোবাসতেন।  হাওড়া বম্বে রোডে একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় যশের বাবা যখন গত হলেন তখন  পি জি হাসপাতালে মারা যাবার আগে স্ত্রীকে কানে কানে কিছু একটা বলে গিয়েছিলেন যেটা বাড়ির আর কেউ শুনতে পাড়েনি। যশের মা এরপর থেকে ওঁদের বালির বাড়ি থেকে খুব একটা বাইরে কোথাও যেতেন না। বাড়িতে বসে টি ভি দেখা, বই পড়া আর গান গাওয়া ছাড়া আর কোন দিকেই ওঁর ইন্টারেস্ট ছিল না। যশ কানপুরে আই আই টি তে ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এলো যখন তখন দেখল ওঁর বিধবা মা হটাত যেন বদলে গেছেন। আগের মত কারো সাথে বেশি কথা বলেন না। বোনের সাথে রোজই খিট খিট লেগেই আছে।

যশের বোন ওর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। এবার বি এ ফাইনাল দিল। যশদের বাড়িতে একতলায় জ্যাঠারা আর দোতলায় যশরা থাকে। ওপরে ঠাকুরদা ঠাকুমার ঘর এখন খালি। ঠাকুমাও ঠাকুরদার মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যেই মারা যান, যশ তখন সবে কানপুরে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ঠাকুমার শেষ কাজে যশ এসে কয়েকদিন থেকেও গেছিল। তখনো যশ দেখেছে ওর মা দু বছর আগে বাবার এক্সিডেন্টে মৃত্যুর ধাক্কাটা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু কলেজ শেষে বাড়ি এসেই সেই দেখে মা একদম অন্য রকম হয়ে গেছে।    

যশ বোনের কাছ থেকে জানতে পারল ওর জ্যাঠার মেয়ে পরী নাকি মায়ের সাধের হারমোনিয়াম নিচে নিয়ে গেছে গান শিখবে বলে, কিন্তু দুই মাস হয়ে গেছে এখনো সেটা ফেরত দেয়নি। জিজ্ঞাসা করলেই বলে বাবা কিনে দিলে এটা ফেরত দিয়ে যাব। যশের এই জ্যাঠতুতো বোন ওর চেয়ে দু বছরের আর শীর্ষের চেয়ে তিন বছরের ছোট। যশের বোন নুড়ি ওর চেয়ে একটু বড়। ও নাকি বোনকে অনেকবার বলেছে কিন্তু ও কিছুতেই ফেরত দিচ্ছে না। এদিকে ওর গানের মাষ্টারও প্রায় রোজই আসে। এখন যতক্ষন না মা ঐ হারমোনিয়াম হাতে ফেরত পাবে ততক্ষন মা শান্ত হতে পারবে না। যশ ভাবল বাবার এই উপহার হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়েই মা এতো বিরক্ত হয়ে আছে। 

কিন্তু আসল ঘটনাটা অন্য জায়গায়। যশের ঠাকুরদা পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া একটা দশ গ্রামের মুল্যবান হীরা বসানো সোনার আংটি বাবাকে দিয়ে গেছিলেন মারা যাবার আগে। সেই আংটির বর্তমান মুল্য নাকি কয়েক কোটি টাকা। যশের বাবা ছাড়া সেই আংটিটার কথা আর কেউই জানতেন না, এমনকি ওঁর জ্যাঠা বা পিসিও না। যশের বাবা সেই অত্যন্ত মুল্যবান আংটিখানা একটা ছোট ফারের তৈরি খরগোশের পুতুলের পেটের ভিতরে তুলোয় মুড়িয়ে ঢুকিয়ে রেখে ওঁর আনা সেই বিদেশী হারমনিয়ামের ভিতরে টেপ দিয়ে চিপকে রেখে দিয়েছিলেন যাতে সেটা যে ঐখানে আছে কেউ ভাবতেই না পারে। আর সবচেয়ে আশ্চর্য হল ঐ হারমোনিয়ামটাও কেউই খুলতে পারবে না যতক্ষণ না তাতে একটা বিশেষ সুর বাজানো হচ্ছে। যশের বাবা হারমোনিয়ামে সেই সুর বাজিয়ে সেট করে সেটা লক করে দিয়ে গেছেন।

যশের বাবা সেই সুরটা ঠিক মারা যাবার আগের মুহূর্তে ওর মাকে কানে কানে বলে গেছিলেন। আর সেই কারণেই উনি কিছুতেই বাড়ি থেকে বের হতেন না বা ঐ হারমোনিয়াম হাতছাড়া করতে চাইতেন না। যশকে একদিন রাতে বোনের আড়ালে সব খুলে বললেন ওর মা। যশ শুনে অবাক হয়ে গেল যে এতো মুল্যবান হীরার আংটি, যেটা ওর দাদু বাবাকে দিয়ে গেছেন সেটা এখন ওদের হাতছাড়া হয়ে আছে। এদিকে ওর মা এই এক চিন্তায় অস্থির হয়ে দিনে দিনে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

যশের নতুন চাকরীতে ওকে দশ দিনের মধ্যেই সল্ট লেকের অফিসে জয়েন করতে হবে। অন্য দিকে নুড়িও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়বার জন্য ভর্তি হবে। যশ ঠিক করল ওর আর বোনের দুজনেরই যাতে সুবিধা হয় কলকাতার সেরকম জায়গায় বাড়ি ভাড়া নিয়েচলে যাবে। যশ ঠিক করল ওদের নিচতলাটা ভাড়া দিয়ে দেবে আর এই শিফট করবার ছুতোয় পরীর কাছ থেকে বাবার শেষ স্মৃতি ঐ হারমোনিয়ামটাও ফিরিয়ে আনবে। বদলে যশই পরীকে একটা দেশী হারমোনিয়াম কিনে দেবে যাতে ওর গান শেখার কোন ক্ষতি না হয়।

চাকরীতে জয়েন করে যশ আগে বোনের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করা ও ভাল পরিবেশে একটা ফ্ল্যাট খোঁজার কাজে লেগে গেল। সি আই টি রোডে একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট পছন্দ হতেই যশ সেটা বুক করে ফেলল এদিকে বোনকেও ফর্ম ফিল আপ করিয়ে সাথে নিয়ে গিয়ে এম এতে ভর্তি করিয়ে দিল যশ। শেষে ওদের শিফট হবার আগের দিন সন্ধ্যায় হারমোনিয়ামের দোকানে গিয়ে যশ অর্ডার করে রাখা হারমোনিয়ামটা ডেলিভারি নিয়ে সোজা জ্যাঠাদের ঘরে গিয়ে ঢুকল। মা আর বোন আগে থেকেই ওখানে বসে কথাবার্তা বলছিল তখন। যশকে একটা নতুন হারমোনিয়াম নিয়ে ঢুকতে দেখে পরী লাফিয়ে উঠল। এটা ওর নিজের জন্য এনেছে শুনে দাদাকে জড়িয়ে ধরল পরী।

ওদের হারমোনিয়ামটা তো নিয়ে এলো সাথে করে যশ। কিন্তু বুঝতে পারছিল ঐ হারমোনিয়ামটা খুলবার জন্য হাতুড়ি বা স্ক্রু ড্রাইভার জাতীয় কিছু জিনিষ দিয়ে অনেক রকম ভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। যশের মা বললেন,’ আমি বুঝতে পেরেছি , এটা তোর জ্যাঠার কাজ। আমার মনে হচ্ছে শাশুড়িমা জানতেন ব্যাপারটা আর মারা যাবার আগে ওঁকে সব বলে গেছেন। তাই উনি এতদিন যাবত এটা নিজেদের কাছে আটকে রেখে খুলবার জন্য সব রকমের চেষ্টা করেছেন। দেখনা জায়গায় জায়গায় কেমন দাগ আর খোসটা লেগে আছে।‘

যশ নতুন বাড়িতে গিয়ে একদিন মাকে চেপে ধরল হারমনিয়ামের সুরটা অন্তত ওকে বলতে। বোন তখন ইউনিভার্সিটিতে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর হাসি মুখে হারমোনিয়ামটা বিছানার উপর রেখে যশের মা বললেন,’ আমি জানি এটা কিভাবে খুলবে। কিন্তু তুই আমাকে কথা দে যে এই গোপন রহস্য তুই আর কারো সাথে শেয়ার করবিনা।‘ যশ মাকে জড়িয়ে বলল,’ আমি কথা দিলাম মা। বোন বা বৌ কাউইকেই বলব না।‘  

এবার যশের মা হারমনিয়ামে বাজালেন ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে’। সুরটা বাজতেই সেই বিদেশী হারমোনিয়াম খুলে গেল আর বেরিয়ে এলো এক অদ্ভুত সুন্দর খরগোশের পুতুল। একধারের চেন খুলবার পর দেখা দিল সেই অনিন্দ্য সুন্দর হীরের আংটি যার মুল্য আজ কুড়ি কোটি টাকারও বেশি।

                             ———শেষ———