Nari 4

ভালোবাসার রঙ  

অনেকদিন বাদে দেখা হলে একটা মানুষকে চেনাটা অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। সেই কবে অনিতা আর নূপুর একসাথে বি এ পড়েছে একই কলেজে, তাও প্রায় দশ এগার বছর হয়ে গেছে। বিয়ের পর এখন নূপুরের চেহারাটা একটু ভেঙে গেছে আর অনিতা এখন বেশ মোটা হয়ে গেছে। তাই হয়ত নূপুর অনিতাকে আজ ট্রেনে এতদিন বাদে দেখে প্রথমে ঠিক চিনতেই পারছিল না।

নূপুর যাচ্ছে কল্যাণীতে, ওর বড়দির বাড়িতে। আজ ওদের দিদির নতুন বাড়ির গৃহ প্রবেশের নিমন্ত্রণ আছে ওখানে। অনিতা সেই একই ট্রেনে ওদের কামরায় উঠল দমদম স্টেশন থেকে। ট্রেন চালু হবার পর নূপুর ওর ছেলেকে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখাচ্ছিল ডানদিকের বনগাঁ লাইনের ট্রেন লাইন আর বোঝাচ্ছিল যে এই এখান থেকেই বনগাঁ যাবার ট্রেন গুলি বেঁকে ডান দিকে চলে যায়।

নূপুরের বাড়ি মানিকতলা, শিয়ালদায় ট্রেনে উঠেই ডান দিকের জানলার পাশে সিট খালি পেয়ে ছেলেকে নিয়ে বসে পড়েছে আর ওর কত্তা বিমান বসেছে ভিতরের রোঁতে, জানালার পাশে। আজ নেতাজি জয়ন্তীর ছুটি , আর তাই বোধ হয় ট্রেনে বেশি লোক নেই। কল্যাণী  লোকালটা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। বিমান ছেলেকে ডেকেছিল ওর পাশে বসতে কিন্তু নয় বছরের সঞ্জয় মার সাথে জানালার পাশেই গিয়ে বসেছে।

অনিতা ছিল দেখতে খুব সুন্দর ছটফটে আর নূপুরের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনেকেই ওর সাথে প্রেম করবার চেষ্টা করত তখন। পূর্ব সিঁথিতে নিজেদের বড় বাড়ি, নূপুর ওদের বাড়িতে কলেজে পড়ার সময় গেছে একবার। অনিতা ট্রেনে উঠে ঠিক নূপুরের পাশেই এসে বসেছে। পাশে বসা খুব সেজে গুজে দামি শাড়ি পড়ে থাকা মহিলাটির  দিকে তাকিয়ে নূপুরের ওকে ভীষণ চেনা চেনা মনে হচ্ছিল , কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিল না। উলটোদিকের লোকটার সাথে খুব আসতে আসতে কথা বলছে কে এই মহিলা ?

কয়েক মিনিট চিন্তা করতেই নূপুরের মনে পড়ে যায় যে পাশে বসা মহিলাটি আর কেউ নয়, এ হল অনিতা। ওর কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আসলে এতদিন বাদে দেখছে তাই চিনতে পারছিল না। নূপুর বা হাতের কনুই দিয়ে ছোট করে একটা গুঁতো মারে আর বলে ,”কি রে, চিনতে পারছিস না ? “

হটাত এইভাবে একজন গুঁতো মারায় অনিতা একটু চমকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায় আর মুহূর্ত খানিক দেখেই বেশ জোরেই বলে ওঠে,” আরে, নূপুর না ? হ্যাঁ হ্যাঁ , চিনতে পারব না কেন ? কিন্তু তুই খুব রোগা হয়ে গেছিস আর অনেক বদলে গেছিস নূপুর, তাই প্রথমে চিনতে পারিনি। আর কত দিন বাদে দেখা বলতো ?”

“তা প্রায় দশ এগার বছর হবে। এই ট্রেনে করে কোথায় যাচ্ছিস এখন ?” নূপুর কথা বাড়ায়। অনিতা নূপুরের দিকে ঘুরে বসে বলে,” আমি শ্যাম নগর  যাবরে। আজ শনিবার তো, ভাবছি একটা পূজো দিয়ে আসি। “ কথাটা বলেই সামনের লোকটার দিকে তাকিয়ে অনিতা আবার বলে,”এই শুনছো ? এই যে আমি তোমাকে বলেছিলাম না নূপুরের কথা, এই সেই নূপুর। কলেজে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল ।“

লোকটার বয়স হয়ত চল্লিশ বা তার একটু কম , বিমানের চেয়ে বোধ হয় কমই হবে। বিমানের এখন এক চল্লিশ চলছে। তবে এর চেহারাটা সুন্দর, ফর্সা লম্বা আর মুখে চাপ দাড়ি। বিমান আবার দাড়ি গোঁফ সব কেটে ফ্রেস থাকতে ভালোবাসে। লোকটার পড়নে পাজামা পাঞ্জাবি আর পায়ে দামি কোলাপুরি চপ্পল। অনিতা নিজেও লাল আর হলুদ রঙের দমি তাঁতের শাড়ি আর ম্যাচ করা ব্লাউজ পরেছে। বোঝা যাচ্ছিল যে ওরা এই সকাল সকাল সত্যিই মন্দিরে পূজো দিতে যাচ্ছে। অনিতার বিয়ের কার্ড পেয়েছিল নূপুর কিন্তু ওরা তখন সিকিম গেছিল বেড়াতে আর তাই যেতে পারেনি। নূপুর ভাবল অনিতার বরটা হেভি হয়েছে তো।

অনিতার কথায় ভদ্রলোক জোর হাত করে নমস্কার করে নূপুরকে আর নূপুরও একই ভাবে হাত জোর করে নমস্কার করে ওনাকে। লোকটা এক চিলতে হেঁসে বলল,” আপনার কথা বিয়ের পরে থেকে অনেক বার শুনেছি অনিতার মুখে। আর কলেজে প্রত্যেক ডিবেটে আপনারা যে প্রতিপক্ষ  ছিলেন সেটা নিয়ে অনেক কাহিনীও শোনা হয়ে গেছে আমার। তা আপনার উনি কোথায় ?”

নূপুর লজ্জা পেয়ে বলে, “ হ্যাঁ, এইতো ওপাশে……এই যে শুনছো ? এখানে এসে বসোনা।“ নূপুর ওর বর বিমানকে ডাকে। বিমান ওখানে বসে পাশের সিটে বসা লোকটার খবরের কাগজের পিছন দিকের খবরটা পড়ছিল তখন। “হ্যাঁ, এই যে আসছি…।“ বলতে বলতে উঠে এসে অনিতার বরের পাশে বসে বিমান ওনার সাথে হ্যান্ড সেঁক করে বলে,”হাই, বিমান, বিমান মজুমদার। কলকাতা পুলিশ।“

এবার অনিতার বর নিজের পরিচয় দেয়,” অসীম সামন্ত, কলকাতা মেট্রো রেলে আছি। ভালই হল আপনার স্ত্রী আর আমার স্ত্রীর অনেক দিন বাদে দেখা হওয়ায় আমাদেরও আলাপ পরিচয় হয়ে গেল আজ।“ নূপুর এবার ওর বন্ধু অনিতার সাথে আলাপ করিয়ে দেয় বিমানকে। আর সাথে সাথে ওর ছেলেকে দেখিয়ে বলে, “এই যে আমার ছেলে বিভাস। ক্লাস ফোরে পড়ছে। বিভাস হ্যালো বল মসিকে।“

নূপুর লক্ষ করে বিমান হাত জোর করে অনিতার দিকে নমস্কার করার সময় অনিতা মুখ নিচু করে শুধু বলে,” নমস্কার।“ তারপরে চুপ করে ঐভাবেই মুখ নামিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। বিমানকে কেমন যেন অপ্রস্তুত লাগল নূপুরের । একটু অবাক হয়ে কথা বলতে বলতে দুজনকেই দেখতে থাকে নূপুর।  একটু বাদে নূপুরের দিকে তাকিয়ে অনিতা জিজ্ঞাসা করে,” তোরা কোথায় চললি রে ?”

অনিতার কথার জবাব দিতে গিয়ে নূপুর লক্ষ করে বিমান আর অনিতার দিকে তাকাচ্ছে না , শুধু অনিতার বরের সাথেই কথা বলে চলেছে। অনিতার বর অসীম খুব স্মার্ট লোক। মেট্রো রেলে খুব উঁচু পোষ্টে চাকরি করে। নূপুরের বিয়ের এক বছর পর অনিতার বিয়ে হয়েছে সম্বন্ধ করে। দমদম মতিঝিলে নিজেদের খুব বড় বাড়ি অসীমদের। বাবার বড় বাজারে বিরাট ব্যবসা, দুখানা গাড়ি আছে ওদের। নূপুরের বিয়ের পর ওর সাথে এই প্রথম দেখা হল অনিতার। কথায় কথায় অনিতাই ওকে জানালো সব।

নূপুরের বর বিমান কলকাতা পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর , হেয়ার ষ্ট্রীট থানায় পোস্টিং। আগে দমদমে থাকতো, মানিক তলায় টু বেডরুমের ফ্লাট কিনেছে বছর পাঁচেক আগে। পুলিশ থেকে পাওয়া একটা রয়াল এনফিল্ড মোটর সাইকেলে অফিস যাতায়াত করে। ছেলে বিভাসকে ভাল স্কুলে পড়াচ্ছে, বড় হলে ওকে ডাক্তার করার ইচ্ছা। অনিতার একটাই মেয়ে, ক্লাস থ্রিতে পরে। ওকে বাড়িতে দিদার কাছে রেখে ওরা বেড়িয়েছে । সোমবার ওর ফাইনাল পরীক্ষা আছে , তাই ওকে আনেনি।

নূপুর আর অনিতা সুরেন্দ্র নাথ মর্নিং কলেজে বি এ তে পড়তো আর একই সাথে ওরা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে। ওদের দুজনের মধ্যে ছিল যেমন বন্ধুত্ব তেমনি দুজন সবসময় ক্লাসের যে কোন ডিবেটে একজন আরেক জনের  বিরোধিতা করত। এই নিয়ে ওদের বন্ধুরাও খুব হাসাহাসি করত আর ওদের পিছনে লাগতো। তবে ডিবেট হয়ে যাবার পর ওদের মধ্যে আর কোন ক্ষোভ বা রাগ থাকতো না।

অনিতার বিয়ে সম্বন্ধ করে হয়েছে শুনে নূপুর একটু অবাক হয়ে যায়। ওর বেশ মনে আছে অনিতা ওর দাদার বন্ধু কোন একটা ছেলের সাথে প্রেম করত কিন্তু ওদের কাছে ছেলেটার কোন গল্প করেনি কোনদিন। কিন্তু সেই অনিতা সম্বন্ধ করে বিয়ে করল কেন সেটাই বুঝতে পারল না নূপুর। তাহলে কি পরে ওদের ছাড়া ছাড়ি হয়ে যায় ? কলেজে একবার ওদের ক্লাসে ‘এরেঞ্জ ম্যারেজ না লাভ ম্যারেজ’ এই ডিবেটে অনিতা লাভ ম্যারেজকেই সাপোর্ট করেছিল আর নূপুরের এরেঞ্জ ম্যারেজ যুক্তির বিরোধিতা করেছিল। অনিতা বলতো  এরেঞ্জ ম্যারেজ করলে বেশির ভাগ লোকই অসুখী হয়, তাই লাভ ম্যারেজ সবচেয়ে ভাল।

অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হল সেই নূপুর পড়ে বিমানকে বিয়ে করল ভালোবেসে আর অনিতা বিয়ে করল সম্বন্ধ করে, একেবারে বিপরীত মেরুর চিন্তা ভাবনার দুটো মেয়ে সত্যিকারের বিয়ের সময় একে অপরের পথটা বেছে নিয়েছে। অনিতার সাথে ওর বিয়ের পর নূপুরের আর কোন যোগাযোগ হয়নি। আজ অনিতার সেই প্রেমের পরিণতি ঠিক কি হয়েছে জানবার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল নূপুরের, কিন্তু ওর বরের সামনে ওকে জিজ্ঞাসা করে কি ভাবে ? নূপুর ভাবে অনিতাকে পড়ে ফোন করে জেনে নেবে।

সারা রাস্তা বিমান আর অসীম খুব গল্প করে সময় কাটিয়ে দেয় আর ঠিক হয় এরপর একদিন রবিবার ওদের মানিকতলার বাড়িতে অনিতা ওর বর আর মেয়েকে নিয়ে এসে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আড্ডা মেরে যাবে। নূপুর ওর নম্বর নিয়ে নেয় আর অনিতাকে বলে ও পরে ফোন করে ডেটখানা জানিয়ে দেবে। পুলিশের চাকরি, বিমানের ডিউটি বুঝে ডেট ফিক্স করবে। অসীম শর্ত দেয় যে এর পরের বার কিন্তু তাহলে মতিঝিলে ওদের বাড়িতে গেট  টুগেদার, সেটা যেন মাথায় থাকে।

শ্যামনগর স্টেশনে অনিতা আর অসীম ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়ল। নূপুর মনে মনে একবার মায়ের উদ্দেশ্যে নমস্কার করে নেয়, এখনো পর্যন্ত এই শ্যাম নগরের কালী বাড়ি দর্শন হয়নি ওর। বিমান এগিয়ে এসে নূপুরকে সরিয়ে ছেলের পাশে বসে। নূপুর একটু রেগে গেলেও মুখে কিছুই বলেনা। ওর তখন একটাই চিন্তা মাথায় ঘুরছে অনিতা তখন বিমানকে দেখে মুখ নিচু করে বসে ছিল কেন ? এখন ট্রেন থেকে নেমে যাবার সময়ও একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল বিমানের দিকে, নূপুরের দৃষ্টি এড়ায় নি।

যেই মেয়ে প্রথম থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল বাবা মার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করবে সেই নূপুর ওর ছোট মামার বিয়ের সময় বিমানকে প্রথম দিন দেখেই একদম বোল্ড আউট হয়ে যায়। নূপুর তখন বি এ পাশ করে সবে কলকাতা টেলিফোনে চাকরিতে ঢুকেছে। এক বছর বাদে সেবার শীতের সময় ওর ছোট মামার বিয়েতে ওরা বরযাত্রী যায় কাশীপুরে আর ওখানেই দেখে বিমানকে।

বিমান ওর বন্ধুর বোনের বিয়েতে কাশীপুরের বাড়িতে বর যাত্রীদের দেখা শুনা করছিল। রাতে বাসর ঘরে  সবাই ধরা ধরি করায় কিশোর কুমারের কয়েকটা বাংলা গান গেয়ে আসর মাত করে দেয়। ছেলে পক্ষের দুজন মেয়ে ছিল, নূপুর আর ওর মাসির মেয়ে নিতা। কিন্তু যেহেতু নিতা গান জানেনা নূপুরকেই মামার আদেশে কয়েকটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে হয়। সেই যে বিমানের নূপুরকে ভাল লেগে যায় এরপর ওর সাথে  প্রায়ই বিমান দেখা সাক্ষাৎ করতে থাকে আর দিনে দিনে ওদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

নূপুরও সত্যি সত্যি বিমানকে ভালবেসে ফেলে। ওদের মেলামেশার সময় একদিন বিমান ওকে বলেছিল যে ওর আগে অনেক গার্ল ফ্রেন্ড ছিল, কিন্তু নূপুরের মত কেউ না। নূপুর হল সবার থেকে আলাদা। আর তাই ওকে বিয়ে করে ওকে নিয়েই সুখী হতে চায়। নূপুর, যে কোনদিন কারো সাথে প্রেম করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি, বিমানের কথার চাতুর্যে আর ওর সুন্দর ব্যবহারে ওর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। অবশেষে মাকে সব বলে দেয় আর ওর মা বাবাকে জানায় ওদের সম্পর্কের কথা। তালতলার মেয়ে নূপুর আর দমদমের সেভেন ট্যাঙ্কের ছেলে বিমানের বিয়ে হয়ে যায়।

বিয়ের পর পাঁচ বছর নূপুর বিমানকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিল। কিন্তু বিভাস হবার প্রায়  তিন বছর পর থেকে বিমানের মধ্যে নূপুর কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ করতে থাকে। আগে সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফিরত, কিন্তু হটাত ওর বাড়িতে ফিরতে রাত হতে থাকে আর জিজ্ঞাসা করলে বলে অফিসের কাজ ছিল। রাতে প্রায়ই ওর সেল ফোনে ঘন ঘন ম্যাসেজ আসতে থাকে। দমদম থেকে নতুন ফ্ল্যাটে আসবার পর থেকে আরও বেশি দুরে সরে যেতে থাকে আর ওরা এমনকি ওদের বিছানাও আলাদা করে নেয়। বিভাস এখন ওর মার সাথেই ঘুমায় আর বিমান অন্য ঘরে একা একা শোয়।

নূপুরের মনে বিমানের উপর ওর ফ্রেন্ডদের  নিয়ে সন্দেহ জাগতে থাকে আর বিমানের অজান্তে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওকে সেল ফোনে কোন এক গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে প্রায়ই হেঁসে হেঁসে কথা বলা শুনে ফেলে। নূপুর বেশ বুঝতে পারে যে বিমান আবার কোন ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চলেছে। এক রাতে দুজনের মধ্যে এই নিয়ে অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি হয় আর এরপর থেকে ওদের সম্পর্কের চিড় ধরতে থাকে।

দুই রবিবার বাদে এক রবিবার অনিতা আর অসীম ওদের মেয়ে রায়াকে নিয়ে এলো নূপুরদের বাড়ি। অনিতা আজ গোলাপি আর লাল রঙের কাজ করা ঢাকাই জামদানি পড়েছে আর অসীম জিনসের উপর একটা খুব সুন্দর হাল্কা সবুজ রঙের টি সার্ট। রায়া মেয়েটা ভীষণ শান্ত আর সুন্দর দেখতে হয়েছে। প্রায় সমবয়সী বিভাস আর রায়া বিভাসের ঘরে গিয়ে কম্পুটারে বসে যায় গেম খেলতে।

বাইরে ক্যাটারার থেকে মেইন কোর্সের খাবার আনিয়েছিল নূপুর। তবে নিজে হাতে ফিস ফ্রাই আর একটা হায়দ্রাবাদি মিষ্ট ডাবল কা মিঠা বানিয়ে খাওয়াল ওদের। অনিতা আজ অনেকটা ফ্রি কথা বার্তা বলছে আর নূপুর লক্ষ করল বিমান যেন অনেক সহজ হয়ে কথা বলছে আজ। অসীমকে বরং একটু গম্ভীর দেখাচ্ছে আর ও কথাও বলছে কম। তবে অনিতার কথায় নূপুরের আজ মনে হয় যে ওর কলেজ জীবনের ধারনাটা যে কত বড় ভুল ছিল সেটা এখন ও বেশ বুঝতে পাড়ছে। সম্বন্ধ করে বিয়ে করে ওরা বেশ সুখে আছে এখন।

নূপুর মনে মনে নিজের কথা ভেবে কষ্ট পায়। ওর বড় জ্যাঠার বন্ধুর ছেলের সাথে সম্বন্ধ এসেছিল ওর, কিন্তু নূপুর ছেলেটাকে দেখেই নাকচ করে দেয়। সেই ছেলেটার চেহারা বিমানের মত সুন্দর ছিল না, বরং গায়ের রঙ চাপা ,মোটা আর চোখে চশমা পড়া সেই গোয়েংকা কলেজের প্রোফেসরকে নূপুর নিজের জীবন সঙ্গী হিসাবে মেনে নিতে পারে নি। এখন মনে হয় ঐ ছেলেটা হয়ত বিমানের চেয়েও ভাল আর সৎ ছেলে ছিল।

কিন্তু মানুষের মন কি আর একই ধারায় বয়ে চলে ? বিমানকে দেখে আর ওর কথা বার্তা শুনে সেদিন নূপুর ওর প্রেমে মোহিত হয়ে গিয়েছে আর বিমানকেই জীবন সঙ্গী বেছে নিয়েছে। ওর বন্ধু বলতো ভালবেসে বিয়ে করেই নাকি সুখী হয়। কিন্তু আজ নূপুর ভাবে, কোথায়, ও তো  বিমানকে মনে প্রাণে ভালবেসেছে কিন্তু আজ ও সুখী না কেন ? বিমান কেন ঘরে স্ত্রী থাকতেও অন্য মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে ? দিন দিন এসব কথা নিয়ে চিন্তা করে আর বিমানের সাথে অশান্তি করে নূপুরের চেহারাও ভেঙে যাচ্ছে। অথচ যেই মেয়ে সম্বন্ধ করে বিয়ের বিরুদ্ধে কথা বলতো সে আজ ঐ সম্বন্ধ করা পাত্রের সাথে বিয়ে করে কত সুখী। কত হাঁসি খুশি থাকে অনিতা। আর অসীমকে দেখেও মনে হয় ওদের দুজনের সম্পর্ক খুব ভাল।

মাসের শেষ রবিবার অনিতাদের বাড়ি নিমন্ত্রণ। নূপুর আর বিভাসের স্নান হয়ে গছে ,ওরা জামা কাপড় পড়ে রেডি হচ্ছে। বিমান সকাল থেকেই খবরের কাগজ নিয়ে বসে। যাচ্ছি যাব করে স্নানে যায়না আর নূপুরের টেনশন বাড়তে থাকে। এমনিতেই অনেক বেলা হয়ে গেছে, বেলা তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। এরপর কত দেড়ি হয়ে যাবে ওদের। এখন বিমানের স্নান করে ওদের বেড় হতে হতে বেলা দেড়টা বেজে যাবে আর ওরা হয়ত পৌছবে দুটোর পর। অথচ অনিতারা একটার মধ্যেই এসে গেছিল ওদের বাড়ি।

নূপুর আরেকবার তাড়া মারল বিমানকে আর তখন বিমান বলে ওঠে ও অনিতাদের বাড়ির নিমন্ত্রণে যেতে পারবে না। ওকে একবার লাল বাজার যেতে হবে, খুব জরুরী কাজ আছে। নূপুর আর বিভাসকে ও ক্যাব ভাড়া করে বসিয়ে দেবে, ওরা যেন তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যায়।

ক্যাব বুক করে দিয়েছে বিমান। রাগে গজ গজ করতে করতে নূপুর বিভাসকে নিয়ে বেড় হয় আর ওদের তিন তলা থেকে লিফটে নিচে নেমে যায়। হটাত ওর মনে পড়ে অনিতার জন্য কিনে রাখা গিফটের প্যাকেট ফেলে এসেছে। বিভাসকে নিচে দাঁর করিয়ে লিফটে উপরে উঠে আসে নূপুর। দরজায় বেল টিপতে গিয়েও ওর হাত থমকে যায়। ভিতরে তখন বিমান  ফোনে কথা বলছে অনিতার সাথে।

বিমান বলছে, ” না না। আমাকে বার বার এক কথা বোলনা সোনা। আমি কিছুতেই তোমাদের বাড়ি যেতে পারব না। অসীমের সামনে আমি আর দাড়াতে পারব না। কাল ও আমাদের কফি হাউসে একসাথে দেখে ফেলেছে আমি শিওর। আর নূপুর যদি আমাদের সম্পর্কটা জানতে পেড়ে যায় তাহলে কি কেলেঙ্কারি হবে বলতো। তুমি বরং কাল বিকালে তিনটার সময় রাধা হলের সামনে সেই আগের মত চলে এসো। আমি থাকব ওখানে…… হ্যাঁ, ওরা বেড়িয়ে গেছে একটু আগে……।… আমি যাবনা প্লিস … না না……। তুমি এসব চিন্তা করো না। নূপুরই অসীমকে বলবে যে আমার লাল বাজারে কাজ আছে।“

———-x——–